সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ঘটনার পরও যারা অনেকেই এসএসসি-তে স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে সরব হয়েছিলেন, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক পদপ্রার্থীদের স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মেধা তালিকা অনুযায়ী নিয়োগের দাবি করেছিলেন, তাঁরা কিভাবে বগটুই-এর ঘটনার পর নীরবে নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছেন তা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছিল। ওঁদের চুপ থাকা নিয়ে ঝড় উঠেছিল নেটদুনিয়ায়। অনেকেই বলেছিলেন, এদের প্রত্যেকের জীবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান রয়েছে, এরা প্রত্যেকেই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
এক সময় বোমা মজুত ঘটনার প্রতিবাদে কবীর সুমন কন্ঠছেড়ে গেয়েছিলেন- “বাহবা সাবাস বড়দের দল এই তো চাই / ছোটরা খেলবে আসুন আমরা বোমা বানাই।” অথচ সেই তিনি বগটুয়ের ঘটনায় জানিয়ে দেন,‘‘মার্জনা করবেন৷ আমি কোনো ব্যাপারে কোনো মত দেবো না৷ আপনার মঙ্গল হোক৷’’ প্রতিবাদমুখর কবি সুবোধ সরকারের বলেন, ‘‘আমি তো এখন কবিতা উৎসবে৷বিষয়টা আমি জানিও না৷ বলতে পারবো না৷ রামপুরহাটে কোথায়? কখন ঘটলো?আমাকে বিষয়টা দেখতে হবে৷’’ টলিউডের অভিনেতা অভিনেত্রীরা ‘‘শুটিংয়ে ব্যস্ত, শটের মধ্যে রয়েছেন, পরে কথা বলবেন ইত্যাদি প্রভৃতি বলে এড়িয়ে যান। মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরুদ্ধে একদা গর্জে ওঠা পরিচালক অনীক দত্ত মূল বক্তব্যকে পাশ কাটিয়ে জানান, ‘‘বুদ্ধিজীবী শব্দটিই তো খারাপ শব্দ৷ এই বাংলায় গালিগালাজের সমান৷’’ চিত্রকর শুভাপ্রসন্ন জানান, ‘‘এটা একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা৷ মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়৷ তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে অনেক কিছু ভালো হচ্ছে৷ নানারকমভাবে বিরোধীরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে৷’’
তার মানে সবাই যে চুপ করেছিলেন বা পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন; সেটা পুরোপুরি সত্যি নয়, রাজপথে কেউই প্রতিবাদে নামেননি বা গলা ফাটাননি সেকথা বলা যাবে না, কারন পবিত্র সরকারের মতো ভাষাবিদকেও মিছিলে হাঁটতে দেখা গিয়েছে। কিছুদিন আগে স্টুডেন্টস এগেনস্ট ফ্যাসিজম-এর ব্যানারে প্রতিবাদ মিছিলেও পা মেলাতে দেখা গিয়েছিল শহরের অনেক বিশিষ্টজনদের।কিন্তু যারা বাম জমানার অন্তিমকালে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন এবং পরিবর্তনের বাংলায় মমতার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, উল্লেখ্য আনিস খান হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে পূর্ব বর্ধমানের তুহিনা খাতুনের আত্মহত্যা, ঝালদায় কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু আর পানিহাটিতে তৃণমূল কাউন্সিলর অনুপম দত্তের খুন এবং বগটুই-এর ঘটনার পরও রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ তো দূরের কথা, অদ্ভুত নীরবতা পালন করলেন। এতে বঙ্গবাসী অবাক হয়েছিলেন, তাঁদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিলেন বিশিষ্টজনেরা।তাঁরা রামপুরহাট হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কেন এমন একটি ঘটনা রুখতে পুলিশ প্রশাসন আগে থেকে তৎপর হল না? তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেই সঙ্গে প্রশ্ন তোলা হয়েছে আমতার ছাত্রনেতার মৃত্যু ও সেই সঙ্গে দুই কাউন্সিলরের হত্যা নিয়েও। মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা সেই খোলা চিঠিতে সই করেছেন মোট ২২ জন। অনেক দেরিতে হলেও বাংলার বুদ্ধিজীবীদের সিদ্ধান্তে নিশ্চয় রাজ্যের বিরোধী শিবির খুশি। কিন্তু বিরোধিদের খুশিতে কেন তাঁরা এতদিন নীরব ছিলেন, কেন এতদিন তাঁদের বোধদয় হয়নি-এই সাধারণ প্রশ্নগুলি একেবারেই গুরুত্ব হারায় না বরং আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বগটুই-এর ঘটনা অতি সাম্প্রতিককালের হলেও রাজ্যের আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকদিন আগেই ভেঙে পড়েছে, রাজ্যের শাসকদলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে লাগাতার দুর্নিতির অভিযোগ উঠছে, শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে প্রায়শই হিংসা, খুন লেগেই আছে-এসব ঘটনায় আম জনতার মনে আশঙ্কা সৃষ্টি হলেও রাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা সরব হওয়া তো দুরের কথা সরকারের প্রতি কোনও প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেননি। তবে কি তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে না চটিয়ে তাঁর আস্থাভাজন থাকতে চান?