যাবতীয় ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা বলছে বাস্তব সম্মত নয়, বিশেষজ্ঞরাও বলছেন একই কথা। কিন্তু রাজ্য সরকার আদিবাসীদের মতামতের তোয়াক্কা না করে, তাঁদের জল, জঙ্গলের চিরাচরিত অধিকার কেড়ে নিয়ে, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, মূলবাসী জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করে, পরিবেশ প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্রের কথা হেলায় উড়িয়েই দেউচা পাঁচামিতে খোলা মুখ কয়লাখনি স্থাপনের চেষ্টা করছে। কয়লা খনি নিয়ে সরকারের আগ্রাসী মনোভাব স্পষ্ট, কারণ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১০ হাজার কোটির পুনর্বাসন এবং সহায়তা প্যাকেজের কথা জানিয়েছেন। নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করেও তিনি দেউচা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ারও ইঙ্গিত দেন।

মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, আদিবাসীদের ১৩৯ ইতিমধ্যেই জন জমি দিয়েছেন। তবে ঠিক কতজন জমির মালিক কয়লা খনির জন্য সম্মতি দিয়েছেন,তা নিয়ে সরকারের হিসাব সব সময় এক থাকছে না৷ মুখ্যমন্ত্রী ১৩৯ জনের কথা বললেও আগে সরকারের তরফে মোট ১৩১৪ জন জমির মালিকের কথা জানানো হয়েছিল, যাদের মোট জমির পরিমাণ ৬০০ একর। মমতা জানিয়েছেন সরকারের হাতে বর্তমানে এক হাজার একর জমি রয়েছে, সেই জমিতেই কয়লা খনির কাজ শুরুহবে। মুখ্যমন্ত্রী প্রকল্পে জমি দেওয়ার জন্য মোট ৫১০০ জনকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।  মুখ্যমন্ত্রী আরও একবার বলেন, “দেউচা কোনোভাবেই সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রাম হবে না।”

প্রায় ৯.৭ কিমি এলাকা জুড়ে দেউচা পাঁচামি প্রস্তাবিত কয়লা খনি প্রকল্প এলাকায় ১০১৩ টি আদিবাসী পরিবার-সহ সব মিলিয়ে ৩০১০ টি পরিবার বসবাস করে।এই দুই এলাকা ছাড়াও দেওয়ানগঞ্জ এবং হরিনসিংঘাতেও এই কোল ব্লক ছড়িয়ে রয়েছে। এইসব এলাকায় প্রায় ২,১০২ মিলিয়ন টন কয়লা রয়েছে।এই প্রস্তাবিত কয়লাখনি শুধুমাত্র দেউচা পাঁচামির মানুষদের জন্যই নয়, সার্বিকভাবে সভ্যতার জন্যই অমঙ্গলকর।এগোচ্ছে। গত বছর ৯ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় দাঁড়িয়ে এই কয়লাখনির কথা ঘোষণা করেন, প্রায় ১৪ বর্গকিলোমিটার বা ৩,৪০০ একর জমি জুড়ে হবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লাখনি প্রকল্প। প্রকল্পে সরকারি বিনিয়োগের পরিমান ৩৫ হাজার কোটি টাকা। পুর্নবাসন প্যাকেজ ১০ হাজার কোটি টাকার। প্রকল্পে প্রায় এক লাখ লোকের চাকরি হবে। কয়লা খনি প্রকল্পের জন্য উচ্ছেদ হবেন প্রায় ২১০০০ মানুষ। তাদেরক্ষতিপূরণ বাবদ ১০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ, এর মধ্যে পাথর খাদান ক্রাশারের মালিক ও কর্মচারীরাও আছেন।রাজ্য সরকার আকর্ষণীয় ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ ঘোষণার পাশাপাশি জানান, এই প্রকল্প হলে আগামী একশো বছর রাজ্যকে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে কয়লা কিনতে হবে না।

প্রস্তাবিত কয়লাখনি কেবলমাত্র দেউচা পাঁচামির মানুষদের জন্যই নয়, সার্বিকভাবে সভ্যতার জন্যই ক্ষতিকর। সব ধরণের ভূতাত্ত্বিক ক্ষেত্র সমীক্ষার সার কথাই হল এই খনি প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।যে কারণে বাসিন্দাদের বড় অংশই জমি ছাড়তে নারাজ। প্রথম থেকেই তাঁরা প্রকল্পের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, সরকার রুখে দাঁড়ানো গ্রামবাসীদের ওপর পুলিশি নির্যাতন নামিয়েছে। বুদ্ধিজীবী, থিয়েটারকর্মী, শিক্ষাবিদরা খনির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এলাকার আদিবাসীরা প্রতিবাদ করছেন, মুসলিম বাসিন্দাদের বড় অংশও প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। বেশ কয়েকটি মিছিল, টাঙ্গি, কুঠার হাতে আদিবাসী মানুষের সমাবেশ হয়েছে।তাঁরা রীতিমত সরকারি সন্ত্রাস মোকাবিলা করেছেন। বাইক মিছিল করায় বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে মামলা করা হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে পুলিশ প্রতিবাদী জমায়েতে লাঠিচার্জ করে। তাতে আদিবাসীএক নারী গর্ভস্থ সন্তান হারান। এছাড়াও গ্রামে ঢুকে হুমকি, মিথ্যে মামলা দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, দেউচায় মাটির নীচে যে কয়লা আছে তা ভারত সরকার গত শতকের নয়ের দশকেই জানত। কিন্তু সেই কয়লার স্তর অতি পুরু, তার গায়ে রয়েছে কঠিন ব্যাসল্ট পাথরের আস্তরণ। সেখানে কয়লা আছে চারটি স্তরে আর সেই স্তরের মাঝে আছে কঠিন ব্যাসল্টের স্তর। এখান থেকে কয়লা তোলার প্রযুক্তি দেশে নেই বলেই কোল ইন্ডিয়া আগ্রহ দেখায়নি। অত পুরু ব্যাসল্টের স্তর ভেদ করার প্রযুক্তি ন্যাশনাল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের হাতেও নেই। এদিকে দেশে কয়লার চাহিদা বাড়তে থাকায় কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৩ সালেছটি রাজ্যকে মিলিত ভাবে এই কয়লার ব্লক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রাজ্যগুলি একে একে পিছিয়ে গেলেও পশ্চিমবঙ্গ নিজেই গোটা ব্লকটি চায়। ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার তাতে রাজি হয়।

কিন্তু দেউচা পাঁচামির জমি অধিগ্রহণ হবে কোন আইনে? জানা গিয়েছে দেউচায় জমি অধিগ্রহণ ২০১৩ সালের আইনে না-ও হতে পারে। তবে ১৯৫৭ ও ২০১৫ সালের একটি বিশেষ আইন আছে যাতে জনমত বা গণশুনানি অথবা পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্রের তেমন গুরুত্ব নেই৷ ফলে উদ্বেগ বাড়ে পরিবেশ কর্মীদের।নতুন কয়লার খনি সেখান থেকে প্রচুর কয়লা উঠবে, আর খালি জায়গা ভরাট হবে বালি দিয়ে‌। কিন্তু বালি দিয়ে করা শূন্যস্থান ভরাটের কারণে ভবিষ্যতে ভূমিকম্প এবং নদীতে ধ্বস নামার সম্ভবনা তৈরি করবে।কারন ওই বালি উঠবে নদীর পাড় থেকে।

অন্যদিকে কয়লা ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট আর যে দূষন তা জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ব্যাপক ক্ষতিকারক।

অবশ্যই আদিবাসীদের উচ্ছেদ রক্ষা একটা বড় ইস্যু একই সঙ্গে কর্ম সংস্থানের প্রশ্ন ও একটা বড় ইস্যু। প্রশ্ন ভারি শিল্পের নাম করে কর্ম সংস্থানের দোহাই পেড়ে আজও কিআমরা পরিবেশ বিরোধী শিল্পের লক্ষ্যে পা বাড়াবো? কারণ সমস্যা কেবল দেউচার আদিবাসীদের নয়,দেউচার কয়লার ক্ষতিকর প্রভাব যে বাংলার যে কোনও মানুষের উপর পড়বে তার দায় কে নেবে?
Share.

4 Comments

  1. debjani aich on

    এটা এখনই বোঝা যাচ্ছে যে আগামী দিনে দেউচা পাচামি রাজ্য রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুতবপূর্ণ হয়ে উঠবে, বিষয়ট এড়িয়ে যাওয়া যাবে না ।

  2. saikat mazumdar on

    দেউচা পাচামির কয়লা খনি নিয়ে শাসক তৃণমূল বেশ নিশ্চিন্ত কারণ রাজ্য পুরোপুরি বিরো্ধীশূন্য হওয়ায় জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সেভাবে ঝাপিয়ে পড়ার কেউ নেই। যারা আজ
    আন্দোলন করছেন তাদের শক্তিও খুব সীমিত।

  3. souvik sanyal on

    পরিবেশ রক্ষা করতে গিয়ে তবে কি মানুষের খাদ্য-সবাস্থ্য-শিক্ষা ইত্যাদি জলাঞ্জলি দিতে হবে, কর্ম সংস্থান কিভাবে হবে ভারি শিল্প গড়ে না উঠলে? অবশ্য কেন্দ্র কোভিড পরিস্থিতিতেই ৪১টি কয়লা ব্লক বেসরকারিকরণ করেছে।

  4. rabindranath neogi on

    পাচামি জমি রক্ষা কমিটি ও দেউচা পাচামি আদিবাসী জনজাতি জমি রক্ষা কমিটি সংগঠন দুটির পাশে আরও বহু বাম সংগঠন এসে রাজনৈতিক জমি তৈরির চেষ্টা করছে, আসল
    কথা হল কেবল পরিবেশের দোহাই দিয়ে শিল্পের বিরোধিতা করা না বিকল্প শিল্পের ভাবনা তৈরি করা…

Leave A Reply

Exit mobile version