এক নজরে

প্রাচীন পারস্যের পিতা সাইরাস 

By admin

March 17, 2025

প্রজাদের প্রতি তাঁর আচরণ এতটাই স্নেহপূর্ণ এবং সম্মানজনক চিল যেন তারা তাঁর নিজের সন্তান। প্রজারাও তাঁকে পিতা হিসেবেই মানতো। এমন রাজা আর কে আছে যে সাম্রাজ্য পতনের পরেও ‘পিতা’ উপাধি নিয়েই মারা গিয়েছেন। কেবল তাই নয়, পিতা উপাধি পেয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে যাদের তিনি পদানত করে নিজের অধীনে এনেছিলেন। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক ও ঐতিহাসিক জেনোফোন পারস্যের আকিমেনিড সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সাইরাসের প্রসঙ্গে উচ্ছিসিত ছিলেন। তিনি সাইরাসকে নিয়ে সাইরোপেডিয়া (Cyropaedia) নামে জীবনীগ্রন্থ লিখেছিলেন। তাঁর গুণে মুগ্ধ ছিলেন স্বয়ং আলেকজান্ডার। পরবর্তীতে থমাস জেফারসন, মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি এবং ডেভিড বেন গুরিয়নের মতো অনেকেই তাকে মনে করতেন নিজেদের আদর্শ হিসেবে।পারসিকদের কাছে সাইরাস ছিলেন পিতা এবং ব্যাবিলনীয়দের কাছে মুক্তিদাতা। একমাত্র তিনিই ইহুদি নন, যাকে বাইবেলে মেসিয়াহ বা স্রষ্টার প্রতিশ্রুত প্রতিনিধি বলে উল্লেখিত। মুসলিমদের একটি অংশ তাকে কোরআন শরীফে বর্ণিত যুল কারনাইন বলে দাবি করে। সমাজ, সংস্কার, রাজনীতি ও বিশ্বাসের ইতিহাসে সাইরাস প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের উপর যে প্রভাব ফেলেছিলেন, তা আর কেউ পারেনি। কিন্তু কে এই সাইরাস?  

বস্তুত সাইরাস তাঁর পিতার পরে উত্তরাধিকার হিসাবে মনোনীত হন এবং ইতিহাসে  সাইরাস দ্য গ্রেট নামে পরিচিত হয়েছিলেন। প্রাচীন পারস্যের গোত্রীয় প্রশাসন ও আধিপত্য ভেঙে স্থাপন করেছিলেন আকিমেনিড সাম্রাজ্য। গ্রিসের ঐতিহাসিক হেরোডোটাস এবং জেনোফোন দুজনেই বিশ্বাস করতেন সাইরাসের দেহে রাজকীয় রক্ত প্রবাহিত। পারসিক সূত্রকে অনুসরণ করে তাদের দাবি, পারস্যের ক্যামবিসেস ও মিডিয়ার রাজকন্যা ম্যানডেনের সন্তান সাইরাস। পরবর্তী বেশিরভাগ ঐতিহাসিক তা মেনে নেন, যদিও মতভেদ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। প্রথমদিকে পিতার মতো তিনি মিডিয়ার রাজা ও নানা আসটিয়াজেসের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক রেখেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে বিদ্রোহ করেন, সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হলে উভয়পক্ষে মুখোমুখি দুই দফায় মোকাবেলা হয়। সাইরাস বিজয়ী হন এবং আসটিয়াজেসকে বন্দী করেন। প্রথমবারের যুদ্ধ দু’দিন স্থায়ী হয়, বিজয়ী হন আসটিয়াজেস। প্যারাগাদেইতে দ্বিতীয়বার মুখোমুখি হলে জ্বলে ওঠে সাইরাসের বাহিনী। আসটিয়াজেস রাজধানী একবাটানায় পালিয়ে গেলেও দ্রুত আত্মসমর্পণ করেন।

সাইরাস রাজকোষ একবাটানা থেকে প্যাসারগাদেইতে স্থানান্তর করার নির্দেশ দেন। এরপর আসটিয়াজেস আনশানদের রাজা কুরুশ- এর বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য অগ্রসর হন। যুদ্ধে আসটিয়াজেসের বাহিনীই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। তাকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে নেওয়া হয়। তারপর কুরুশ একবাটানা থেকে গনিমত আনশানে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আসটিয়াজেসের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন সাইরাসকে নতুন উদ্যমে রাজ্য গঠনে আত্মনিয়োগে উৎসাহী করে। যেখানে একসময় যুদ্ধ হয়েছিল, সেই প্যাসারগাদেইতে প্রতিষ্ঠিত হয় শহর। তথাকথিত শহরের মতো নয়, উপাসনা কিংবা আচারের জন্য শহরটিতে গড়ে উঠেছিল বিশেষ নির্মাণ। তার মধ্যে উপাসনাগার, আবাসিক ভবন, সম্মেলন কেন্দ্র এবং সবকিছু। সৌন্দর্য বাড়াতে আনা হয় এসেরীয় ধারার স্থাপত্য এবং আয়োনীয় ধারার গাঁথুনি। একবাটানা ও ব্যাবিলন অভিযানের মাঝামাঝি সময়ে সাইরাস লিডিয়া জয় করেন। লিডিয়ার রাজকোষের জন্য সাইরাস একজন প্যাকটিয়েস নিযুক্ত করেন। কিন্তু সে বিদ্রোহ প্রস্তুত করতে থাকে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে নিয়ে। ধীরে ধীরে হারপ্যাজাস লাইসিয়া, সাইলেসিয়া, ফিনিশিয়া প্রভৃতি অঞ্চল জয়ের মাধ্যমে এশিয়া মাইনরে পারসিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।এইভাবে সাইরাস সমগ্র পারসিয়া, হিরকানিয়া এবং সাবেক মিডিয়াকে একত্রিত করেন। আস্তে আস্তে পারস্য সাম্রাজ্য পূর্বের বেদুইন গোত্রগুলোকেও অধীনস্থ করেন। আর্মেনিয়াকেও রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নিজের সমর্থক টাইগ্রেনেস অরোনটিডকে ক্ষমতায় বসান। পরবর্তীতে ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন যত অঞ্চল ছিল, সব সাইরাসের অধীনস্থ হয়।

সাইরাসকে জরাথুস্ত্র মতবাদের অনুসারী মনে করা হয়, যদিও তার প্রমাণ নেই। কেউ কেউ তাকে বহু ঈশ্বরবাদী বলে থাকেন, যিনি স্থানীয় পারসিক দেবতাদের উপাসনা করতেন। জেনোফোন মনে করেন, তিনি ছিলেন মিথ্রার সমর্থক। সেই সঙ্গে ব্যাবিলনীয় দেবতা মারদুক তো আছেই। যে সব বিদেশিদের জোর করে ব্যাবিলনে আটক রাখা হয়েছিল, তাদেরকে নিজভূমে ফিরে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ইহুদিরাও ছিল, যারা ব্যাবিলনীয় বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভের পর জেরুজালেম ফিরে গিয়ে মন্দির নির্মাণ করেন। তার দুটো ফরমান বাইবেলের বুক অব ইজরাদে সংরক্ষণ করা হয়। একটি হিব্রুতে, অপরটি আরামায়িকতে। সাইরাসের জীবনের শেষের দিকের ন’বছর নিয়ে বেশি কিছু জানা যায় না। হেরোডোটাসের দাবি সাইরাস মাস্যাজেটাই যাযাবর গোষ্ঠিকে দমন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বিরোধী রানী টমিরিস পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রতিজ্ঞা করেন। প্রথম দফায় সাইরাস বিজয়ী হলেও দ্বিতীয় দফায় পরাজীত হতে হয় দুঃসাহসী রানী টমিরিসের কাছে। সেখানে তার শিরশ্ছেদ করা হয়। টেসিয়াসের মতে, ডেরবিসেস নামের মধ্য এশিয়ার যাযাবর গোষ্ঠীর সাথে সংঘাতে তার মৃত্যু হয়।

খুব সম্ভবত সাইরাস প্রকৃতপক্ষেই মধ্য এশিয়ার অঞ্চলসমূহে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে মারা যান। প্যাসারাদেইতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। পুত্র দ্বিতীয় ক্যামবিসেস উত্তরাধিকার নিয়ে সিংহাসনে বসেন। উত্থান আর পতনের মধ্যবর্তী সময়ে সাইরাস দ্য গ্রেট এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে যান। কয়েকটি অভিযানের মাধ্যমে পতন ঘটান সেই সময়ের সবচেয়ে শক্তিমান প্রতিপক্ষদের। পুরো মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং এশিয়া মাইনরে নিজের আধিপত্য ঘোষণা করেন। রাজ্য বিজয়ের পর সাইরাস প্রায়ই পুরনো কর্মচারি ও অমাত্যদের আগের পদে বহার রাখতেন। ফলে প্রশাসন ব্যবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতো। যথেষ্ট সম্মান দেখাতেন সংস্কৃতি ও বিশ্বাসকে। অনেকটা এই কারণেই তিনি প্রজাদের কাছে বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এমন এক সাম্রাজ্যের ভিত টিকে ছিল পরবর্তী কয়েক শতক, যা পারস্যের ঐতিহাসিক যুগের সুচনা করেছিল।