একদা যে সিপিএম কম্পিউটার যাতে বাংলায় না ঢোকে তার জন্য বিরোধিতা করেছিল, আজ সেই দলই সংগঠন থেকে শুরু করে শুন্য ভোটের বাক্স কিভাবে ফের ভরতি করা যায় তার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে টেক স্যাভি রুটে হাঁটা শুরু করলো। উল্লেখ্য, সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার তারা অনেক আগেই শুরু করেছিল, এবার আইটি সেলের উপর যেমন জোর দিতে চাইছে সিপিএম পাশাপাশি পেশাদার সংস্থার পরামর্শ অনুসারে চলতে চাইছে। অনেক দেরিতে হলেও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করলো সিপিএম। এ রাজ্য থেকে সিপিএম ক্ষমতাচ্যূত হয়েছে ১৪ বছর আগে৷ তার পর থেকে সেই দলটির সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষয় ছাড়া অন্য কিছু ঘটেনি। ক্ষইতে ক্ষইতে রাজনৈতিক দল হিসেবে সিপিএম যে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে সেকথা সিপিএমের প্রবল সমর্থকও অস্বীকার করবেন না। পঞ্চায়েত বা পুরসভার মতো নির্বাচনগুলিতে যাও বা দু’একটি আসন কোনোক্রমে জেতা সম্ভব হয়েছে কিন্তু ২০১৯ ও ২০২১ সালের লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে একেবারেই খালি হাতে ফিরতে হয়েছে এ রাজ্যের মার্কসবাদি কমিউনিস্ট পার্টিকে৷ ভোটের রাজনীতিতে সমর্পিত থাকলেও দলটি বিগত ১৪ বছর পরাজয় আর পরাজয়ের সঙ্গে সাজুয্য রেখেই যে দিনকে দিন ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে সেকথাও মানতে নারাজ হবেন না যুগ যুগ ধরে সমর্থন করে আসা সমর্থকেরা। ঠিক এই অবস্থায় গত শনিবার থেকে হুগলির ডানকুনিতে শুরু হয় সিপিএমের ২৭তম রাজ্য সম্মেলন৷ উল্লেখ্য, প্রায় আড়াই দশক পরে কলকাতার বাইরে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন হল।

প্রসঙ্গত, রাজ্য বিধানসভায় শূন্য। বাংলা থেকে লোকসভাতে শূন্য। এমনকি জেলা পরিষদেও শূন্য। পুরসভা বলতে টিমটিম করে জ্বলছে একমাত্র নদিয়ার তাহেরপুর। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে পঞ্চায়েত সমিতির অবস্থাও তথৈবচ।এই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আলিমুদ্দিনের নেতারা প্রায়সই তরুণ প্রজন্মকে সামনে নিয়ে আসার কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁদের মুখের কথা বাস্তবে কতটা প্রতিফলিত হয় ? ডানকুনি রাজ্য সম্মেলনে সিপিএমের নতুন রাজ্য কমিটি তৈরি হয়েছে৷ সেখানে ঠাঁই পেয়েছেন ৮০ জন৷ মহম্মদ সেলিমকেই সেই কমিটির প্রথম বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে ফের রাজ্য সম্পাদক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে৷ নতুন মুখ হিসেবে এসেছেন ১১ জন৷ বেশ কয়েকজন বাদ পড়েছেন বয়সজনিত কারণে৷ গতবারের থেকে এবার মহিলা সদস্যর সংখ্যা বেড়েছে বলে জানা গিয়েছে৷ রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুখেন্দু পানিগ্রাহী, অশোক ভট্টাচার্য, জীবেশ সরকার বাদ পড়েছেন বয়সজনিত কারণে। জীবেশ সরকারের জায়গায় রাজ্য কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন গৌতম ঘোষ৷ একই সঙ্গে মেদিনীপুরের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ-বিতর্কিত’ নেতা সুশান্ত ঘোষকে বাদ দিয়ে তাঁর জায়গায় পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক বিজয় পাল রাজ্য কমিটির সদস্য হয়েছেন৷ বয়স হওয়ায় বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, অমিয় পাত্র, রবীন দেব, জীবেশ সরকার মিলিয়ে পাঁচ প্রবীণ নেতা বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে থাকছেন।

এখন থেকে সর্বহারা দল সিপিএম আইটি সেলের উপর জোর দেওয়া এবং পেশাদার সংস্থার পরামর্শ নেওয়া শুরু করলো। অর্থাৎ সিপিএমও ভোট বা তার রণকৌশলের ক্ষেত্রে তৃণমূল আর বিজেপির পথে হাঁটা শুরু করলো। ২৭তম রাজ্য সম্মেন মঞ্চেই সংগঠনের দুর্বলতা দেখিয়ে দিল ওই পেশাদার সংস্থা আর সেটা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে। কেবল তাই নয়, এই দুর্বলতা থেকে কীভাবে দল বেরিয়ে আসবে, কী পদক্ষেপ নেবে, সেসব পরামর্শও দিতে শুরু করেছে ওই সংস্থা। উল্লেখ্য, সিপিএম শুরু থেকে এই ধরনের সংস্থার বিরোধিতা করে এলেও এবার থেকে সেই পথেই হাঁটতে শুরু করলো। সিপিএম নিয়ে ওই পেশাদার সংস্থা একটি বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করেছে। সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনের মঞ্ছেই সেই রিপোর্ট তুলে ধরা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে সিপিএম যে গ্রাম থেকে শহর জনসংযোগ করে মানুষের উপর নির্ভর করত সেই জায়গাটি থেকে বেশ খানিকটা সরে এল। সেটা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মধ্যে দিয়ে দলের দুর্বলতা কোথায় দেখানোর মধ্যে থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল। এক সময় সারা বাংলার বুথ স্তরে সিপিএমই ছিল কাণ্ডারি কিন্তু সেদিন গত, এখন তাদের অবস্থা সঙ্গীন। বুথ স্তরে সংগঠন প্রায় নেই বললেই চলে। স্বভাবতই সেই বুথস্তরের সংগঠন নতুন করে গোছাতে চাইছে সিপিএম। আর সেই কাজটি যাতে প্রযুক্তির যুগে সুষ্ঠুভাবে হয় সে কারণেই পেশাদারি সংস্থার সাহায্য নিতে চাইছে তারা। ২৭তম রাজ্য সম্মেন মঞ্চের পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বুথস্তরে কমিটি গড়ে তোলার সময়সীমাও বেঁধে দিল। যদিও সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এই পেশাদার সংস্থা টাকার বিনিময়ে কাজ করছে না বলে দাবি করেন কিন্তু আসলে তৃণমূল কংগ্রেস যেমন আইপ্যাকের সাহায্য নেয়, বিজেপি পেশাদার সংস্থার সাহায্য নেয় এবং নিজেদের আইটি সেলও আছে, এবার থেকে সিপিএম সেই পথেই হাঁটতে শুরু করলো।

বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে কেন বামেরা ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছে , আসলে কোথায় সেই দুর্বলতা সেটা সবার সামনে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে ওই সংস্থার রিপোর্ট। জানা গিয়েছে, প্রত্যেকটি বুথের গত ১৫ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করা হবে ওই সংস্থার পরামর্শ অনুসারে। ১৫ বছর আগে এবং পরে কোন বুথে কত ভোট ছিল, কেন কমেছে, এখন কি পরিস্থিতি, কাদের ভোট কতটা বেড়েছে এখন থেকে সিপিএম সবই বিশ্লেষণ করবে, ওই পেশাদার সংস্থার সাহায্যে। পেশাদার সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতেই সিপিএম দলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই ভাবেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে তা আন্দোলনের হাতিয়ার করতে হবে বলে সিপিএম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজ্য সম্মেলনে ভোট প্রচারে বদল থেকে শুরু করে রণকৌশল পরিবর্তনের কথাও আলোচনা হয়েছে। আজ শেষ হবে সিপিএমের ২৭ তম রাজ্য সম্মেলন। কয়েক মাস আগেই ডেটা অ্যানালিস্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং–সহ নানা বিষয়ে লোক চেয়ে তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। সিপিএম যে নতুন পথে হাঁটা শুরু করেছে তার প্রমাণ মিলল এই রাজ্য সম্মেলনে। এবার কি তাহলে সিপিএমের শূন্যের গেরো কাটবে?
