বাংলা গানের ভূবনে শ্যামা সঙ্গীত বহুকাল ধরেই জনপ্রিয়। এই প্রীতি যে কেবলমাত্র কালী সাধকদের কাছেই কিংবা কালী আরাধনা উপলক্ষে, তা কিন্তু নয়। শ্যামা সঙ্গীতের ভাবাবেগ যে কোনো সঙ্গীতপ্রেমীরই মন ছুয়ে যায়। বাংলায় কোনও দিনই তাই শ্যামাসঙ্গীতের ধারা থেমে থাকেনি। অন্যদিকে ধর্মবিশ্বাস বা জাতপাতের দ্বন্দ্ব কখনও শ্যামাসঙ্গীত রচনা বা পরিবেশনায় বাধা হয়ে ওঠেনি। বরং সম্প্রীতি ও সমন্বয়ের বাংলায় রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের পাশাপাশি বিভিন্ন মুসলমান কবিও শ্যামা মা ও শ্যামা সঙ্গীতের ভাবাবেগে মজেছেন, তাঁদের কথা ও সুরে ধরা দিয়েছেন কালী কিম্বা কালী মা। কেবল নজরুলই ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচন’ দেখেননি, তাঁর আগেও বহু মুসলমান ধর্মে আস্থাবান কবি ‘শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে’ শ্যামের নাম জপেছেন।

একটা সময়ে বেশ কয়েকজন মুসলমান ধর্মের সঙ্গীতশিল্পী হিন্দু নাম নিয়ে ভক্তিগীতি ও শ্যামাসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মহম্মদ কাশেমের কথা আসে সবথেকে আগে যিনি ভক্তিগীতি গাইবার সময় ‘কে মল্লিক’ নাম নিতেন। এর উলটো ঘটনাও রয়েছে— অনেক সঙ্গীতশিল্পী ইসলামি গান গাইবার সময় মুসলমান নাম নিয়েছিলেন। যেমন ধীরেন্দ্রনাথ দাস, চিত্ত রায় প্রমুখ শিল্পী ইসলামি গান রেকর্ড করার সময় গণি মিঞা, দিলওয়ার হোসেন নাম ব্যবহার করেছিলেন। সেই সময়ে যে এঁরা উদার মানসিকতা দেখিয়েছিলেন, তার তুলনা হয়না তবে গানের চরিত্র অনুধাবন করে শিল্পীদের নাম বদলে দিয়েছিল তখনকার রেকর্ড কোম্পানি, সেটা পুরোপুরি বাণিজ্যিক স্বার্থের কারনেই।

অন্যদিকে রামপ্রসাদ সেন যেসব গান রচনা ও সুর করেছেন তার মধ্যে একাধিক ভক্তিমূলক গানের সুরে নানা সময়ের ভারতের নানা প্রান্তের সাধক, কবীর, নানক, মীরাবাঈ, সুরদাস প্রমুখের সঙ্গীতের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন, রামপ্রসাদের বিখ্যাত গান ‘মন রে কৃষিকাজ জান না…’ এই গানটির দার্শনিক ভাবনার সঙ্গে নানকের ‘ইহু তনু ধরতি’ গানটির পরোক্ষ প্রভাব লক্ষণীয়। প্রসঙ্গত, আল্লাহর প্রেমে মগ্ন হয়েও মরমিসাধক হাছন রাজা বলেন— আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,/আমি কি তোর যমকে ভয় করি।/শত যমকে তে দিব, সহায় শিবশঙ্করী। এরই পাশাপাশি হাছনের ব্যাকুল আকাক্ষ্মা গেয়ে ওঠে— ‘আমি মরিয়া যদি পাই শ্যামেররাঙ্গা চরণ’। বেশ কয়েক পুরুষ হিন্দু ঐতিহ্যের ধারা প্রবহমান ছিল হাছন রাজার রক্তে কিন্তু তাঁর মরমিলোকে সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঠাঁই ছিল না। তাই আল্লহে ভরসা রেখেও কালীর লীলারসে বিভোর হয়ে তিনি গেয়ে ওঠেন- ‘ওমা কালী! কালী গো! এতনি ভঙ্গিমা জান।/ কত রঙ্গ ঢঙ্গ কর যা ইচ্ছা হয় মন।।/ মাগো স্বামীর বুকে পা দেও মা ক্রোধ হইলে রণ…’।

মরমিসাধনার মূল কথাই হল জাতধর্ম বিভেদের ওপরে ওঠা। মরমি সাধক সব ধর্মের নির্যাস, সব সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যকে আধ্যাত্মপোলব্ধির ভেতর আপন করে নেন বলেই তাঁর অনুভবে ধর্মের এক অভিন্ন রূপ ধরা পড়ে। তিনি সম্প্রদায় ধর্মের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সর্বমানবিক ধর্মীয় চেতনার এক লোকায়ত ঐক্যসূত্র রচনা করে। হাসন রাজার সংগীত, সাধনা ও দর্শন এই চেতনারই প্রতিফলন। যদিও কালী ভক্ত হাছন রাজা বলেন— ‘কে বুঝিতে পারে মায়ের অনন্ত ব্যাপার’।

বাংলায় মুসলিম কবিদের মধ্যে একেবারে গোড়ার শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতাদের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় কবি সা বিরিদ খাঁ-এর কথা। তিনি চট্টগ্রামের শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান সমাজের মানুষ। তাঁর মননের সঙ্গী ছিল সুফি সাধনার ঐতিহ্য। সা বিরিদ খাঁ বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা। তবে কোনোটিরই সম্পূর্ণ অংশ পাওয়া যায়নি। বিদ্যাসুন্দর, রসুলবিজয় এবং হানিফা ও কয়রাপরী নামে তাঁর তিনটি কাব্যের খন্ডিত পুথি পাওয়া গিয়েছে।

বিদ্যাসুন্দর ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রচিত একটি রোমান্টিক প্রণয়কাব্য। বিদ্যাসুন্দর কাব্যের কাহিনী কালিকামঙ্গলের অন্তর্গত এবং রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র-সহ অনেক কবি একই কাহিনী ভিত্তিক কাব্যের রূপ দিয়েছেন। সা বিরিদ খাঁ-র কাব্যের কাহিনী মূলত মানবরসের লৌকিক কাব্য হলেও, দেবী কালীর মাহাত্ম্য প্রকাশই এই কাব্যের অন্যতম উপজীব্য। কাব্যরস সৃষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য কবির ছিল না। তবে এই আখ্যানের নামধাম ও কাহিনিতে কবি সা বিরিদ খাঁ কিছু নতুনত্বের সঞ্চার ঘটাতে চেয়েছিলেন। হিন্দুর পুরাণ এবং অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ সম্পর্কে কবি ওয়াকিবহাল ছিলেন তার কিছু ইঙ্গিত মেলে এই কাব্যের পাতায় পাতায়।

কালী মাহাত্মে আবিষ্ট হয়ে তাঁর রহস্যাবৃত রূপে ভক্তি ও ভালবাসায় মগ্ন হয়েছিলেন বাংলার আরও অনেক মুসলমান কবি। নওয়াজিস খান, আলি রজা, আকবর আলি, মির্জা হুসেন আলি, মুনসি বেলায়েত হোসেন, সৈয়দ জাফর খাঁ প্রমুখ লিখেছিলেন শ্যামাসঙ্গীত। হিন্দু কবিদের তুলনায় সংখ্যায় কম হলেও, এঁদের লেখা শ্যামাসঙ্গীত এক সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। উল্লেখের দাবি রাখে কবি সৈয়দ জাফরের লেখা- ‘কেন গো ধরেছ নাম দয়াময়ী তায়/…সৈয়দ জাফর তরে/ কী ধন রেখেছ ধরে/ সম্পদ দুখানি পদ হরের হৃদয়’। পাশাপাশি বলতে হয় মুনসি বেলায়েত হোসেনের গান- ‘কালী কালী বলে কালী, সহায় হইলে কালী/ নাথেরে পাইবে কালী/ ঘুচিবে এ বিরহানল’। বাংলার এই সব কবিরা ধর্মে নিষ্ঠাবান মুসলমান হয়েও কালী ভক্তি বা রসে আপ্লুত হয়ে শ্যামাসঙ্গীত রচনায় যেভাবে ব্রতী হয়েছিলেন তা এক দুর্লভ সম্প্রিতী ও সমন্বয়ের নিদর্শন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version