এক নজরে

ভিখারিদের সাম্যবাদ

By admin

August 06, 2023

(গত রবিবারের পর)

আমরা গৌরের বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালাম। বাইক দুটো নিম আর বেল গাছের তলায় রেখে বারান্দায় পাতা কাঠের চেয়ারে বসলাম। চেয়ার‌ থেকে বাড়ির মেঝে, দেওয়াল এমনকি তুলসী তলার দিকে নজর দিলেই চোখে পড়বে এক অসাধারণ সৌখিনতার ছাপ। গোটা চৌহদ্দি জুড়ে এক সাবেকিয়ানার শৈল্পিক ছাপ স্পষ্ট। সীমানা পাঁচিলের বাইরের ও ভিতরের দেওয়াল থেকে ঘরের দেওয়াল জুড়ে ম্যুরাল বা আ্যপ্লিকে সাজানো। প্রাকৃতিক রঙে রাঙানো। তুলসী মঞ্চেও সিরামিক টাইলস্-এর উপর ফুটিয়ে তোলা শ্রীশ্রী মহাপ্রভু ও বৈষ্ণব প্রবরদের সংকীর্তনরত ছবির সমাহার। একদম উপরে রঙ দিয়ে লেখা মহানাম। মঞ্চের চাতালে রয়েছে ডুগি, একতারা আর বাঁয়া।  সকালেই গাব মাখিয়ে রোদে রাখা হয়েছে যন্ত্রগুলোকে। এখন তাদের মরা মরশুম।  যন্ত্রে গাব খাইয়ে রাখতে হয় সযত্নে।”ভাদরের‌ টান” কেটে আসবে নতুন আশ্বিন। ডাক পড়বে আসরের। দূর‌, দূর গাঁ গঞ্জ শহরে নাম যজ্ঞের দল নিয়ে যায় তারা। বাইরের রাজ্য থেকেও ডাক আসে। সেই সব আসর মাতিয়ে দেয় তারা। অনেকগুলো দিন কাটিয়ে ফিরে আসে গ্ৰামে। এখন শুধু মাধুকরীই ভরসা। তাই অলস সময়ে সব গোছগাছ করে রাখতে হয়। এখন আবার রঙ আর সঙের যুগ। তবুও এই পরিবারটি একটু ব্যাতিক্রমী ও রক্ষণশীল বলেই মনে হয়েছে আমাদের। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারার এরাই সার্থক উত্তরসূরি। এখনও এদের বাড়িতে প্রতিদিন গানবাজনা ও নাম সংকীর্তনের আসর বসে। নতুন নতুন গান তুলে সুর দিয়ে আগামী মরশুমের আসরের জন্য প্রস্তুতি নেয়। এমনিতেই মোবাইলের যুগে আধ্যাত্মিক ও দেহতত্ত্বের গানের প্রতি  আগ্ৰহ ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছে সাধারণ শ্রোতা ভক্তের দল। শুধু সাধু-বাউল-ফকিরের আসরে শোনানোর জন্য কিছু নতুন গান তুলতেই হয়। বাঙলার মেলা মোচ্ছবেও ঢুকেছে চটকদারি আর রঙের গানের নামে বেলেল্লাপনা বা অশ্লীলতা। এই গভীর আশঙ্কা, হতাশা আর আতঙ্কের কথা শুনতে পাওয়া যায় আসনধারী আখড়া-অস্থলে। জ্যেঠামশাই ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন- এখন আর গুরুমুখী সাধন ভজন কই? যা দেখছি সবই তো পেট ভরানো ভেক ধারীর দল। আরও বললেন বানিজ্যমুখী সাধু বাউলের ভেকধারীর ইতিহাস। কথায় কথায় সময় গড়িয়ে চলেছে তার নিজস্ব ছন্দে। এবার ওঠার জন্য তাড়া দিল গৌর। দুপুর গড়িয়ে যাওয়ায় সবারই তাগাদা এলো প্রসাদ‌ গ্ৰহনের জন্য।

গৌরের পিসিমা আসন পিঁড়ি করে দিল বারান্দায়। গৌর কাঁসার জলঘটি নিয়ে দাঁড়িয়ে। কুয়োতলায় আমরা হাত পা ধুয়ে বারান্দায় বসে পড়লাম আসনে। বাঙলার সেই নকশি কাঁথার মতো আসনগুলোতেও হাতের কাজে সমৃদ্ধ। এখান থেকে পটশিল্পীদের গ্ৰাম ভরতপুর খুব কাছেই। ট্রেডিশন্যাল আর্ট ফর্মের আঁতুড় ঘর এই শুশুনিয়া পরিমন্ডল। রয়েছে তার গৌরবময় অতীত ।আমাদের সঙ্গেই মধ্যাহ্নে অন্নপ্রসাদ গ্ৰহনের জন্য হাজির হলেন গোউর আর তার জ্যাঠামশাই। পিসিমা মঞ্চের ডান দিকে থাকা কেলিকদম্ব তলার মন্দির থেকে আনলেন মহাপ্রভু সহ দেবদেবীর বিগ্ৰহকে নিবেদন করা ভোগ প্রসাদের থালা। সেই ভোগপ্রসাদ জ্যেঠামশাই, গৌর ও   আমাদের দু’জনের পাতায় দিয়ে গেলেন তিনি। কাঁসার থালার উপর দেওয়া আছে পদ্ম পাতা। তাতে নুন‌, লেবুও আছে। আমরা শুরু করার আগে জ্যেঠামশাই উদাত্ত কণ্ঠে উদ্বাহু হয়ে বলে উঠলেন- ‘জয় গৌর নিতাই প্রেমানন্দে‌ হরি হরি বোল! ‘আমরাও অনুসরণ করলাম তাঁকে। তুলসী পাতা সরিয়ে ভাত, ডাল, তরকারি মিশিয়ে মাটিতে এক গ্ৰাস ভোগ নিবেদন করলেন ইষ্ট দেবদেবী ও পূর্ব পুরুষদের। মোটা লাল স্বর্ণ চালের ভাত, আধভাঙা বিরি কলাইয়ের ডাল, কুমড়োর পাঁচ মেশানো তরকারি, আলু পোস্ত আর দু’ তিন রকমের ভাজা রয়েছে। তার সঙ্গে ছোট সৌখিন কাঁসার বাটিতে দেওয়া আছে পায়েস ও মিস্টি। পাথরের বাটিতে আছে আমড়ার চাটনি। গৌরের ছোট ভাই সবার পাতে দিয়ে গেলেন ঘরের তৈরি গাওয়া ঘি। ঠাকুরের এই ভোগ আজ আমাদের কাছে অমৃত সমান। আমরা দু’জনেই মোহিত হয়ে গেছি। খেতে খেতে অন্ন ভোগের মোটা চালের সুখ্যাতি করছি দেখে জ্যেঠামশাই থালায় এঁটো হাত নামিয়ে বললেন সবই তাঁর দয়া। নিজেদের চাষের ধান থেকে ঢেঁকিতে ছেঁটে এই চাল বাড়িতেই হয়। যা গ্ৰহন করছেন তার মধ্যে পোস্ত বাদে সবটাই নিজেদের জমিতে ফলানো। শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মোটা চাল তবুও এতো ভালো স্বাদ? অনেকদিন ভুলে গেছি এই মিষ্টতার অনুভূতি। গৌর জানালো, তাদের বাড়ির দক্ষিণ পূর্ব কোনে আছে গন্ধেশ্বরী নদীর উপর বাঁধানো চামকরা ড্যাম। পাশাপাশি পুকুর, জলাশয়ও আছে। নতুন করে তারা ধনকোড়া- বাঁকজোড় জলাশয় লাগোয়া কয়েক বিঘে ধানী  জমি কিনেছে। সারা বছরই সেচের জল পায়। বর্ষা ভালো হলে ধান সহ অন্য ফসল মার খায় না। জ্যেঠামশাইয়ের উদ্যোগে ও নেশায় হারিয়ে যাওয়া সাবেকি ধান চাষ হয় এই মাঠে। তাঁকে দেখে পড়শি চাষীরাও ভুতমুড়ি, কলমকাঠি, চূর্ণকাঠি, সীতাশাল, লক্ষ্মীভোগ সহ নানান জাতের ধান চাষ করে। আরও একটি বিশেষত্বের খোঁজ দিলেন তিনি। জ্যেঠামশাই ছাড়াও বেশ কিছু সম্পন্ন ও সৌখিন চাষী গোবিন্দভোগ ধানেরও চাষ করেন। এখানকার ডাঙা-ডহর, তড়া-গোড়া, কানালী, বাইদ জমিতে স্বল্প মেয়াদী ধান ও সবজি চাষের উপর জোর দিয়েছে স্থানীয় চাষীরা।

খাওয়া শেষ করে জ্যেঠা মশাইয়ের পিছু পিছু আমারও কুয়োতলায় চলে এলাম হাত মুখ ধোয়ার জন্য। গৌর এগিয়ে দিল জল বালতি আর ঘটি। সকাল থেকে এখানে কয়েকটি বিষয় আমাদের ভাবিয়েছে। যেমন- প্লাস্টিক, পলিথিন, নাইলন কিম্বা ফাইবার, মোল্ডেড ফাইবার ব্যাবহার হয় না। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এই ধারা লক্ষ্যনীয়। তবুও একটু প্রগতিশীল বা নগরায়ণের ছোঁয়ায় থাকা বেশ কিছু গ্ৰামে ঢুকে পড়েছে প্লাস্টিক, ফাইবার।

হাত মুখ ধুয়ে ফিরে এলাম বারান্দায়। কয়েক মিনিট বসার পর গৌরই আমাদের বসার জন্য তাদের বৈঠক খানায় নিয়ে এলো।

(পরবর্তী অধ্যায় আগামী রবিবার)