ইতিহাসের হিসাব অনুসারে প্রায় ১৯০ বছর আগেকলকাতায় প্রথম কেক তৈরি করেছিলেন ডেভিড উইলসন নামে এক সাহেব। তখন তিনি এই শহরে একটি বেকারি খুলেছিলেন। এর কয়েক বছর পরে সেই সাহেব ধর্মতলায় একটি হোটেল চালু করেন। প্রথমে সেই হোটেলের নাম ছিল অকল্যান্ড। তারপর নাম বদলে হয় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল।
গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে ফ্রাঙ্ক ওরেলের মত ক্রিকেটার, সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ-এর নাম।সেকালে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল হিসাবে যতটা খ্যাতি পেয়েছিল ততটাই জনপ্রিয় ছিল তার কেক। অতীত কলকাতার কেক বলতে গ্রেট ইস্টার্ন-এর নাম করবেন প্রায় সকলেই। গত শতাব্দীতেও গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের ক্রিসমাস কেক পছন্দ করতেন বহু অভিজাত পরিবার।
আজ নয় আদিকাল থেকেই কলকাতার কেকের ঠিকানা ধর্মতলা বা নিউ মার্কেট। সুদূর বগদাদ থেকে নাহুম ইজরায়েল নামের এক ইহুদী কলকাতায় এসে কেকের দোকান শুরু করেছিলেনহগ মার্কেটের আমলে। সাহেবদের বিশেষ পছন্দের ছিল সেই দোকানের কেক।ইস্রায়েল নাহুমের কেকের ভক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।কেক, পেস্ট্রি, ব্রাউনি, ম্যাকারুন, ক্যান্ডিতে শহরের মানুষের আভিজাত্যের রুচিকে সযত্নে লালন করে চলেছে নাহুম।এছাড়া প্রাচীন কলকাতার আরও দুটি কেকের দোকানের নাম মল্লিক কনফেকশনার্স আর ইম্পিরিয়্যাল বেকার্স অ্যান্ড কনফেকশনার্স।
মল্লিক কনফেকশনার্স ১৮৭৪ সালের প্রতিষ্ঠান। সারা বছর কেক নিয়ে মাতামাতি থাকে না সে কথা মানেন কর্ণধার সৌরভ মল্লিক। তিনি এও বললেন, অন্য সময় সব কেকের দোকানেরই বাজার খারাপ থাকে। বড়োদিন আসার চার-পাঁচ দিন আগে থেকেই ভিড় লেগে যায়। তখন সেটা সামাল দেওয়াটা চ্যালেঞ্জ। তা না হলে বাপ ঠাকুর্দার আমলের সুনাম নষ্ট হবে। কারণ কনফেকশনারির ইতিহাসে মল্লিকদের দোকানকে এখনও কলকাতা মনে রেখেছে। করোনার বছরেও কেকের চাহিদা তুঙ্গে। দামও এ বছর সামান্য বাড়াতে হয়েছে।
ইম্পিরিয়্যাল বেকার্স অ্যান্ড কনফেকশনার্সও বয়েসে দেড়শোর কাছাকাছি। এই দোকানটিও সুনাম অর্জন করেছে তাদের কেকের কারণেই। শেখ আসিফ রহমান, ইম্পিরিয়্যাল বেকার্স অ্যান্ড কনফেকশনার্সের বর্তমান কর্ণধার জানান, শীতকাল আর কেক-এই দুয়ের যে এক গভীর মেলবন্ধন রয়েছে তা তাঁদের পাঁচ পুরুষ ধরে জেনে এসছেন। ইম্পিরিয়্যাল প্রতিষ্ঠা করেছিল আসিফের ঠাকুমার বাবা। আসিফের ঠাকুরদা খুব ভালো কেক বানাতেন বলে তাঁর ঠাকুমার বাবা ঠাকুরমার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। সেই বিয়ের পর থেকে রহমান পরিবার বংশ পরম্পরায় ইম্পিরিয়্যালের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। বড়দিন উপলক্ষে ইম্পিরিয়্যালের স্পেশাল কিছু কেক তৈরি করে। যার মধ্যে থাকে ওয়ালনাট, চিজ কেক, লাইট ফ্রুট কেক, রয়্যাল কাজু কেক, প্লাম কেক, আমন্ড স্পেশাল কেক।
দেশ ভাগের অনেক আগেই চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছিলেন মনোতোষ বড়ুয়া। ‘ফিরপো’-তে সামান্য বেতনে শিক্ষানবিশ হয়ে যোগ দিয়ে অল্পদিনেই আয়ত্ত করে ফেলেন কেক তৈরির খুঁটিনাটি। তারপর একদিন চাকরি ছেড়ে নেমে পড়লেন বেকারির ব্যবসায়। ‘বড়ুয়া বেকারি’-র ফ্রুট কেক, পাম কেকেরস্বাদ লেগে গেল কলকাতার মুখে।কিন্তু পারিবারিক অশান্তিতে বড়ুয়া বেকারি ভেঙে চার টুকরো হয়ে গেল। তবে আজও ক্রিক রো-তে শ্বাস ফেলছে বড়ুয়া বেকারি। সারা বছর পাউরুটি, ডিসেম্বর এলেই শুরু হয়ে যায় কেক। মাত্র ২০ দিন মেলে সেই কেকের দেখা। ৯০ পেরনো বেকারিতে আজও ওভেন নয়, কাঠ কয়লার উনুনেই বানানো হয় কেক।
প্যাকেজিঙের জৌলুস বলতে কিছুই নেই। কিন্তু তাও সে আজও বাঙালির আবেগে জড়িয়ে রয়েছে। টিফিন কেক বলতেই একটি নামই উচ্চারিত হয়-‘বাপুজি কেক’। শীতল চন্দ্র লাহা ১৯৬৯ সালে বেকারি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বোন অপর্ণা জানা। তখনও ‘দ্যা নিউ হাওড়া বেকারি’-র কেক ‘বাপুজি কেক’ নামে বাংলার মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে ঢুকে পরে। খেটে খাওয়া মানুষ, ছাত্র-ছাত্রীদের টিফিন বক্সে বাপুজি কেকের চাহিদা এখনও তুঙ্গে। তাই করোনা বাজারেও দৈনিক ৫০ হাজার টিফিন কেক তৈরী করেন তাঁরা।