চীনা নববর্ষ কেবল চীন নয়, বিশ্বজুড়ে পূর্ব এশীয় সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এবং বিশেষ উৎসব। পরিবার, ঐতিহ্য এবং সুখের প্রতীক হল এই উৎসব। শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতেই প্রতি বছর এই নববর্ষ উৎসবটি অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করা হয়। এ বছর চীনা নববর্ষ শুরু হয়েছে ২৯ জানুয়ারি এবং চলবে ১২ ফেব্রুয়ারি। এক পক্ষকাল ধরে চীন এবং অন্যান্য স্থানে উৎসব চলবে। চীনে ২৮ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারি ছুটি, যাতে পরিবার এবং সম্প্রদায় নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে একত্রিত হতে পারে। যেহেতু চীনা নববর্ষ চন্দ্র ক্যালেন্ডারের উপর নির্ভর করে তাই প্রতি বছর ভিন্ন তারিখে ঘটে। তবে ২১ জানুয়ারী থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ঘটে৷

চীনা নববর্ষ উদযাপনের ধারণাটি প্রথম আসে খ্রিষ্টপূর্ব ১৪ শতকে। তখন শাসনক্ষমতায় ছিল শাং রাজবংশ। চান্দ্র নববর্ষের উৎপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি মত প্রচলিত রয়েছে। একটি মত অনুযায়ী বলা হয়, নিয়ান (বছর) নামের এক দানব প্রতিবছরের শুরুতে গ্রামবাসীর উপর আক্রমণ চালাত। অনেক হট্টগোল, উজ্জ্বল রঙের আলো এবং লাল রং ভয় পেত নিয়ান। আর মানুষ এগুলিকে ব্যবহার করে নিয়ানকে তাড়াত। তখন থেকে চীনে ড্রাগনকে শক্তি আর সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। পুরনো বছরের দুর্ভাগ্যগুলি মুছে ফেলতে নববর্ষে লোকজন তাঁদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করেন। চীনের বহু এলাকায় এই নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ড্রাগন নাচ হয়। লম্বা, রং ঝলমলে ড্রাগনের পুতুল তৈরি করা হয় এবং রাস্তা দিয়ে এই ড্রাগন নিয়ে শোভাযাত্রা নববর্ষ উদযাপনের একটা অন্যতম আকর্ষণ।

পারিবারিক পুনর্মিলন চীনা নববর্ষ উৎসবের সবচেয়ে বিশেষ ঐতিহ্য। এই উৎসবে সিংহ এবং ড্রাগন নৃত্যের মতো এই ঐতিহ্যবাহী নৃত্যগুলি মন্দ আত্মাদের তাড়ানো এবং সৌভাগ্য বয়ে আনার জন্য পরিবেশিত হয়। শিশু এবং তরুণদের আশীর্বাদ এবং শুভকামনা জানানোর জন্য লাল খামে টাকা দেওয়া হয় এই উৎসবে। ১৫ দিনের এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে লণ্ঠন উৎসবের মাধ্যমে, যখন রাস্তায় লণ্ঠন জ্বালানো হয়। ঐক্য ও আশার বার্তা ছড়িয়ে দেয় লণ্ঠন উৎসব। বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপী উৎসবে পরিণত হয়েছে চীনা নববর্ষ। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশের পাশাপাশি নিউ ইয়র্ক, লন্ডন এবং সিডনির মতো বড় শহরগুলিতেও মহা জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করা হয় চীনা নববর্ষ উৎসব।

চীনা রাশিচক্র প্রতি বছর একটি প্রাণীকে বরাদ্দ করেছে এবং এই চক্রটি 12 বছর ধরে চলে। ২০২৫ সালে চীনা নববর্ষের প্রতীক হল সাপ, যা জ্ঞান, সৌন্দর্য এবং অন্তর্দৃষ্টির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। সাপের বছরে জন্মগ্রহণকারীদের প্রায়শই আত্মনির্ভরশীল, সম্পদশালী এবং ধৈর্য ও কৌশলের সঙ্গে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে সক্ষম হিসেবে দেখা হয়। ২০২৫ সালে সাফল্যের জন্য সতর্ক পরিকল্পনা এবং বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। নানান রঙের আতশবাজিতে জমকালো উৎসবের মধ্যদিয়ে নানা দেশের নানা জায়গায় শুরু হয়েছে চীনা নববর্ষ। চীনা নববর্ষ বা ‘কং সি ফা চাই-এর অর্থ ‘নতুন বছর আপনার জন্য সমৃদ্ধি বয়ে আনুক’বা ‘শুভ নববর্ষ’। চীনে এ উৎসবকে ‘ছুন জিয়ে’ বলা হলেও ইংরেজিতে তা ‘স্প্রিং ফেস্টিভাল’ বা ‘বসন্ত উৎসব’ নামে পরিচিত।

লাল চীনে সর্বাধিক ব্যবহৃত রঙ। এই রঙ আনন্দ, শান্তি, সুখ ইত্যাদির প্রতীক। চীনাদের উৎসবে লালের ব্যবহার বেশি। তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকেও লাল রঙ থাকে। চীনাদের বিশ্বাস লাল রঙ সৌভাগ্যের প্রতীক। হাত জোড় করে মাথা নুয়ে একজন আরেকজনকে বলেন, ‘কং সি ফা চাই’। একজন আরেকজনের সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করেন। বিবাহিত চীনারা ছোটদের ‘আমপাও’ বা বখশিশ দেন। সম্পর্ক বুঝে এই বখশিশ ৫-১০ রিঙ্গিত থেকে কয়েক শ বা কয়েক হাজার রিঙ্গিতও হয়। ‘আমপাও’ হিসেবে কত রিঙ্গিত দেওয়া হয়েছে তা দেওয়ার সময় বোঝা যায় না। বখশিশ দেওয়ার জন্য আছে বছরের প্রতীক প্রাণীর ছবিওয়ালা লাল রঙের প্যাকেট। যেমন এ বছরের প্যাকেটের গায়ে আছে সাপের ছবি। এই প্যাকেটে বখশিশের নোট দিয়ে মুখ আটকিয়ে দেওয়া হয়। পরে প্যাকেট খুললেই জানা যায় বখশিশ হিসেবে কত রিঙ্গিত পাওয়া গেছে।

কলকাতার ভিতরেও রয়েছে এক টুকরো চিন! ১৯৬২-র ইন্দো-চিন যুদ্ধের পর কর্মসংস্থানের খোঁজে এ দেশে চলে আসেন বহু চিনা পরিবার। সংখ্যাটা নেহাতই কম নয়। বেশ কয়েক হাজার। সেই সময় থেকে আজও কলকাতায় রয়ে গিয়েছে বেশ কিছু চিনা পরিবার।১৭৭৮-এ ওয়াং চাউ আসেন কলকাতায়। তিনিই ছিলেন কলকাতায় আসা প্রথম চাইনিজ। পরবর্তীকালে কলকাতার ট্যাংরায় তাদের ঘাঁটি জমিয়ে বসে বেশ কিছু চিনা পরিবার। তারা মূলত চিনের ‘হাক্কা’প্রদেশের প্রজাতি। চামড়ার ব্যবসা আর রেস্তরাঁর উপরেই নির্ভর ছিল তাদের জীবিকা। পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ট্যাংরা এলাকায় চামড়ার কারখানা চালানো বেআইনি ঘোষণা হয়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় কারখানাগুলি। আবার আর্থিক সঙ্কটে পরে চিনা পরিবারগুলি। আবার দেশ ছাড়েন চিনারা। আজ কলকাতায় চিনাদের সংখ্যা প্রায় দু’হাজারে এসে ঠেকেছে। কিছু চিনা পরিবার আবার তাদের বসতি গড়ে তুলেছে পোদ্দার কোর্টের কাছে টেরিটি বাজার এলাকায়। এই এলাকার চিনারা আদতে ছিলেন চিনের ‘ক্যানটন’ প্রদেশের বাসিন্দা। চিনা শাকসব্জি, সস, এ ছাড়া অন্যান্য চিনা খাবারের স্টল খুলে বিক্রি করতে শুরু করেন তাঁরা।
