আম কুড়োনোর বেলায় কিই না মজা করতাম। উপরে কড়্ কড়্…দু…..ম্! নিচে রাশি রাশি আম। কখনো সখনো উপর থেকে শিল পড়লে তো কথাই নেই। দিদি দের চোখরাঙানি আর ভাইদের খুনসুটি ভীষন জিদ বাড়িয়ে দিত অজান্তেই। গাঙ্গুলি দের “ভট্টাচার্য” জাতের কাঁচা মিঠে আম এর স্বাদটাই আলাদা ছিল। শুধু একটুখানি নুন হলেই জমে যেত। সবার নজর থাকতো ওই গাছতলার পানেই। সাহাগঞ্জ, লিচুবাগান, সার্ভে কলেজ কিংবা নলডাঙা, দেবানন্দপুরের আমতলা,জামতলায় ফেলে এসেছি শৈশব কৈশোর।

এখন আমাদের প্রৌঢ়ত্বের বেলায় আ্যন্ড্রয়েড যুগে হারিয়ে গেছে সেই সবুজ মাঠ, আমবাগান আরও কত কি। ডুব সাঁতার জায়গা করে নিয়েছে বাথরুমের শাওয়ার কিম্বা সুইমিং পুল। এখন আর কেউ জলে ভিজে না। জল থই থই মাঠে উঠেছে ঝাঁ চকচকে বহুতল। মেয়ের আবদারে সাউথ ফেসিং ফ্ল্যাট, একচিলতে ব্যালকনি জুটেছে। দূরে তাকালে কেমন যেন হা হুতাশ করে মন। একবার গ্ৰামের বাড়ি থেকে ছেলে এনেছিল বাবুইয়ের বাসা, তেঁতুল বিচি, লালটুকটুকে কাঁচ ফল, ঝিনুকের খোলা। আরও কত কি আনতে চেয়েছিল সে। মা বলেছিল- রাখবে কোথায়! ব্যাস মন চাইলেও পারলো না আনতে তার পছন্দসই জিনিস।

আমার হারানো সব শৈশবের কথাগুলো শুধু মালার মতো পুষে রেখেছিল সে? মেডিক্যাল পড়া দিদি ভাই কে ডেকে বলে, ‘জানিস ভাই কাল রাতে তোর আনা বাবুইয়ের বাসায় একটা জোনাকি এসেছিল হঠাৎ’। বাবা দেখেছিল ঠায় বসে। বাবা বলছিল, ফেলে আসা গাঁ, তিরতির করে বয়ে চলা কুমারী নদী উঠে এসেছিল ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে। গ্ৰীষ্মের দুপুরে ভিঁড় করেছিল কাঠি আইসক্রিমওয়ালা। চাঁছি,দইওয়ালা এসে হাঁক পেড়ে যাচ্ছিল সমানে। বাবা তুমি ঘুমোও নি! বাবা কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বললো- জানিস খুকু আজও আমাকে হাঁক পেড়ে ডাকে আমতল,জামতলে যাওয়ার জন্য। নটু শাঁখারির সেই মায়াবী ডাক শুনতে পাই- শাঁখা, চুড়ি,পলা,বালা নেবে গো …। কাঁধ থেকে শাঁখার বাক্স নামিয়ে গামছা দিয়ে মুখ হাত পা মোছে। কই গো গিন্নি মা,এক ঘটি জল দাও দিকিনি। আমাদের জন্য শাঁখের তৈরি লকেট, পদক আনতো ভালোবাসার স্মারক হিসেবে।

বড়বেলায় জানলাম নটু ছিল এলাকার হাজারটা গ্ৰামের বার্তাবাহক ও বার্তা প্রেরক। চিঠি কিম্বা খবরাখবরও আদান প্রদান করতো এক গ্ৰাম থেকে আর এক গ্ৰামে। সবার বাড়িতেই ছিল তার সমাদর। একদিন কালবৈশাখীর দুপুরে ঘটলো ধুন্ধুমার কান্ড। মাধ্যমিক দেওয়ার পরও আমতল জামতলে ঘোরার দায়ে,সপ্সপে ভিজে অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসায় পড়লো চ্যালা কাঠের বাড়ি। মা পারেনি ঠেকাতে। পেরেছিল নটু শাঁখারি। এই তো ক’ দিন আগে নটুদের গ্ৰাম ঘুরে এলাম সপরিবারে। সে কি খাতির যত্ন! ছেলে মেয়েদের গল্প শোনালো সারাটা দুপুর। সেই একই গল্প,বলার ধরনটা নাকি সেই আমার মতোই, মেয়ে বলে উঠলো তার নটু দাদুকে। ছেলে বললো- এখনো ওয়াজেদ আলী সাহেব আমাদের মধ্যে রয়েছেন অমর হয়ে। সন্ধ্যা নেমে এলো পাহাড়তলীর ঢাল বেয়ে। শুশুনিয়া যেন ঢুলে পড়লো সারাদিনের ক্লান্তি ছেড়ে।

বাবা আর একদিন নিয়ে যাবে? মেয়ের আবদারে মৃদু স্বরে বলে উঠলাম- ঠিক আছে নিয়ে যাবো আর একদিন সময় পেলেই। ছেলে বললো,- ছোটো বেলার মতো স্কুটারে নিয়ে যাবে নদীর ধারে। সেই আগের মতো ধরে বেড়াতাম ঘাসফড়িং, প্রজাপতি। আবেশে চোখ বন্ধ করে দেখলাম আমার গ্ৰামভারতকে। প্রনাম আমার দেশ, আমার মাকে।