(শেষ পর্ব)
চাকরিহারারা ডিআই অফিসে গিয়েছিলেন বলে মন্ত্রী-সান্ত্রী থেকে সরকারি দলের অনেকেই বেজায় ক্ষুব্ধ, কেউ তো চেঁচিয়ে উঠেছেন এই বলে যে শিক্ষকেরা কেন ডিআই অফিস গিয়েছিলেন? তাঁর চিৎকার বা জিঙ্গাসার ঝাঁঝ যে অতি তীব্র সেকথা স্বীকার করে নিয়েও অতি বিনয়ের সঙ্গে একথাও বলতে হয় যে, শিক্ষকেরা ডিআই অফিস যাবেন তো কি তৃণমূল ভবন বা কালীঘাটে যাবেন, নাকি যারা এই বিরাট দুর্নীতির পাকচক্র থেকে বান্ডিল বান্ডিল টাকা তুলে এনে ঘরের মেঝে ঢেকে ফেললো তারা যাবেন ডিআই অফিস? শিক্ষকেরা তাদের যোগ্যতার প্রাপ্য সম্মান ফিরে পাবেন কিনা, অযোগ্যদের চিহ্ণিত করা হবে কিনা জানতে চাইলে কেন রেগে যাচ্ছেন তৃণমূল নেতা-মন্ত্রী? এ রাজ্যে এমন ফতোয়া কে কবে জারি করলো যে, কারা কোথায় যাবেন আর কোথায় যাবেন না, আন্দোলন করবেন না আলোচনা করবেন তা নির্ধারণ করে দেবেন তিনি বা তারা।
উল্লেখ্য, বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীরাই কিন্তু এই দুর্নীতির কথা প্রথম প্রকাশ্যে আনেন এবং বাগ কমিটির রিপোর্টের পর উঠে আসে নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন অসঙ্গতি যার সাক্ষ্য প্রমাণ আদালতের সামনে উপস্থিত করা হয়। হ্যাঁ এটাও ঠিক, কেবল স্কুল সার্ভিস কমিশনের হলফনামা চোখ দিয়ে দেখলেই স্পষ্ট ফুটে ওঠে দুর্নীতির কত রূপ আর রকম। দুর্নীতিতে আছে মেধা তালিকায় কারচুপি (র্যাঙ্ক জাম্প), সাদা খাতা জমা দেওয়া অর্থাৎ ওএমআর শিটে কারচুপি করে নাম্বার বাড়িয়ে নেওয়া, কাউন্সেলিং-এর তালিকা প্রকাশ না করা, গ্রুপ ডি-এর প্রথমে একটি প্যানেল প্রকাশ করে তা বাতিল করে ফের তা প্রকাশ, এছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশই নেয় নি এমন লোকও চাকরি পেয়েছেন। এই ধরনের নীতি বা দুর্নীতির কথা এর আগে বহুবার আলোচনায় উঠেছে, এর সবথেকে বড় উদাহরণ একসময়ের বাম পরবর্তীতে তৃনমূল সরকারের মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতার চাকরি পাওয়া এবং আদালতের নির্দেশে চাকরি চলে যাওয়া। পরবর্তীতে অঙ্কিতার জায়গায় যিনি চাকরিপেলেন তার চাকরিও চলে যায় দুর্নীতির অভিযোগে- এ যেন অনেকটাই কয়েক পর্বের বাংলা ওয়েব সিরিজ।
এখানে একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল হাইকোর্ট, ডিভিশন বেঞ্চ এবং শীর্ষ আদালত তাদের রায়ে সবাই কিন্তু অযোগ্য প্রার্থীদের সংখ্যা বলেছেন ৭,৫০০। এমনকি সিবিআইও প্রায় তাই। অন্যদিকে বঞ্চিত শিক্ষকরা প্রথম থেকেই দাবি জানিয়ে এসেছেন, অযোগ্য প্রার্থীদের নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়ে যোগ্যদের নিয়োগ করা। আর সেই কারণেই মামলা লড়েছেন, তারা কখনোই পুরো প্যানেল বাতিলের দাবি করেন নি। বহু টাকা করে, ভালো উকিলদের দিয়ে মামলা চালানোর উদ্দেশ্য ছিল একটাই- যোগ্যদের নিয়োগ। চাকরিহারা শিক্ষকেরা তখনই বুঝেছিলেন পুরো প্যানেল বাতিল হলে তাদের দাবি আর পূরণ হবে না। বিষয়টি বহু আলোচিত হলেও বারবার বলতে হবেই কারণ, যোগ্য ও অযোগ্য তালিকা আলাদা করা এবং যোগ্য শিক্ষকদের রক্ষা করার দায়িত্ব সম্পূর্ণতই এসএসসি ও রাজ্য সরকারের। কেবল তাই নয়, এই দায়িত্ব পালন করার যথেষ্ট সময় তারা পেলেও তারা কর্তব্য পালনে চূড়ান্ত অযোগ্যতা ও গাফিলতি দেখিয়েছে। কারণ, অযোগ্য বা ঘুরপথে চাকরি পাওয়াদের রক্ষা করার দায়িত্ব বা কর্তব্য পালনে তারা সক্রিয় ছিলেন সেই দায়ই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর অবশ্যই তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। দলদাস হয়ে কাজের মানসিকতা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা অযোগ্য প্রতিষ্ঠানটির সাফল্যের পরিমাণ গড়ে ৫ শতাংশেরও কম। সিবিআই নিয়ে সাধারণ একটা প্রশ্নই তো তাদের অপদার্থতা এবং আকর্মন্যতাকে প[রমাণ করে দেয়- এমআর শিটের মিরর ইমেজের সন্ধানে তারা কতখানি সক্রিয় ছিলেন। কেন সিবিআই তাদের ডেকে জিঙ্গাসাবাদ করছে না যারা বলছেন ২০২৬- এর নির্বাচনে তারা জিতলে যোগ্য-অযোগ্যর তালিকা প্রকাশ করবেন এবং রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে এসএসসির কাছে যোগ্য শিক্ষকদের তালিকা প্রকাশের ‘সবিনয় আবেদন’ জানাচ্ছেন।
এরপরও যোগ্য শিক্ষকেরা নিজেদেরে দাবি নিয়ে ডিআই অফিস অভিযান করলে তাঁদের উপর মানবিক সরকার পুলিশ ও ঠ্যাঙারে বাহিনি লেলিয়ে দেয় এবং দলদাসেরা দায়িত্ব সহকারে নৃশংস লাঠিচার্জ করে এবং লাথি মারে। এই জঘন্যতম কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানোর ভাষা মানুষের জানা নেই। রাজ্যবাসী শিক্ষককে লাথি মারা হচ্ছে এই দৃশ্য দেখা তো দূরের কথা কল্পনাও করতে পারে না। সরকারের মন্ত্রী-সান্ত্রী-নেতা-ন্যাতা যে যাই বলুক না কেন কিংবা ঝুঁড়িতে কয়েকটা পচা আম থাকলে, সব কটা আম ফেলে দিতে হবে—এই ধরনের নির্বোধ প্রলাপ কিংবা সুবিধাবাদী আশ্রয় নয়, এর প্রতিবাদ করতেই হবে, শিক্ষকদের আন্দোলনের পক্ষেও দাঁড়াতে হবে। কারণ, আদালতের রায়ে যে কেবল যোগ্য শিক্ষকেরা চাকরি হারিয়েছেন তাতো নয়, ওই রায়ের মধ্যে যে ধ্বংসাত্মক প্রভাব রয়েছে তা বহুকাল ধরে বহুদূর পর্যন্ত অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করবে। সেই ক্ষতিতে লাভবান হবেন অনেকেই। প্রশ্ন, এরপর প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্কুল সার্ভিস কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে তো? বহুকাল ধরে সরকার পোষিত মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও পরবর্তীতে উচ্চ প্রাথমিক স্কুলগুলি রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। কংগ্রেস থেকে বাম রাজত্বের প্রথম দুই দশক পরিচালন কমিটির মাধ্যমেই শিক্ষক নিয়োগ হত। নিয়োগে দুর্নীতি ও স্বজন পোষণও হত যথেচ্ছ। সেই দুর্নীতি রোধেই তৈরি হয়েছিল এসএসসি। হালে এসএসসির মাধ্যমে নিয়োগ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। সেই বাস্তবতা ধরা পড়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে, এসএসসি পরীক্ষা দুর্গাপুজো নয় যে প্রতিবছর করতে হবে। অর্থাৎ কেন নিয়ম শৃঙ্খলা বা রীতি নীতি অনুসারে সব কাজ করতে হবে। সেকারণেই ওরা গলা তুলে বলে, ডি আই অফিসে গিয়েছিল কেন?