কলকাতা ব্যুরো: হাঁসখালিতে কিশোরীর ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনায় উত্তাল গোটা রাজ্য। চলছে শাসক-বিরোধী জোর তরজা। ইতিমধ্যেই কিশোরীর প্রেমিক তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতার ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সোমবার এই ঘটনা নিয়ে মুখ খুললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনৈতিক রং না দেখে ঘটনার যথাযথ তদন্ত হবে বলেই আশ্বাস তাঁর। এদিকে রানাঘাট সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের সভাপতি রত্না ঘোষ করকে এদিন ফোন করেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ধর্ষণ কাণ্ডের খোঁজখবর নেন তিনি। রত্না ঘোষ কর জানান, ইতিমধ্যেই অভিযুক্ত ধরা পড়েছে। রাজনীতির রং না দেখেই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মিলনমেলা প্রাঙ্গণের উদ্বোধনী মঞ্চ থেকে সোমবার মুখ্যমন্ত্রী হাঁসখালি কাণ্ড প্রসঙ্গে বলেন, আপনি রেপড বলবেন নাকি প্রেগন্যান্ট বলবেন নাকি লাভ অ্যাফেয়ার্স বলবেন? সেটা খতিয়ে দেখেছেন কী? আমি পুলিশকে জিজ্ঞাসা করেছি। হাঁসখালিতে খুব খারাপ ঘটনা ঘটেছে। মেয়েটি মারা গিয়েছে ৫ তারিখ, পুলিশ জেনেছে ১০ তারিখে। আপনারা বলুন কোনওরকম অভিযোগ থাকলে ৫ তারিখ পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করলেন না কেন? দেহটা পুড়িয়ে দেওয়া হল। আমি সবটা না জেনেও বলছি প্রমাণ পাবে কোথা থেকে? আসলে ধর্ষণ নাকি অন্তঃসত্ত্বা ছিল নাকি অন্য কোনও কারণ আছে? নাকি কেউ ধরে দু’টো চড় মেরেছে? শরীরটা খারাপ হয়েছে। প্রেমের সম্পর্ক তো ছিলই শুনেছি। বাড়ির লোক, পাড়ার লোকেরাও জানত। এখন যদি কোনও ছেলেমেয়ে, কেউ কারও সঙ্গে প্রেম করে, আমার পক্ষে তাকে আটকানো সম্ভব নয়। এটা উত্তরপ্রদেশ নয় যে লাভ জিহাদ করব। এটা তার স্বাধীনতা। হ্যাঁ এটা আমরা নিশ্চয়ই দেখব, যদি কেউ কোনও অন্যায় করে তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারির ক্ষেত্রে কোনও রং দেখা হচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশের পাশাপাশি শিশু সুরক্ষা কমিশনও ঘটনার তদন্ত করবে।
এদিকে মাটিয়া ও মালদহের পর এবার হাঁসখালিতে কিশোরীর ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনার জল গড়ালো কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত। এই ঘটনায় দু’টি জনস্বার্থ মামলা দায়েরের আবেদন মঞ্জুর করলেন প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব। আগামিকাল অর্থাৎ মঙ্গলবার মামলার শুনানির সম্ভাবনা।
এছাড়া কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে জনস্বার্থ মামলা দায়েরের আরজি প্রথমে জানান এক আইনজীবী। তারপর বিজেপির তরফেও একই দাবি করা হয়। প্রধান বিচারপতি আবেদন মঞ্জুর করেন। এরপর প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব এবং বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চে মামলা রুজু হয়। মামলাকারীদের দাবি, গত সোমবার রাতে জন্মদিনের পার্টি থেকে ফেরার পর অসুস্থ হয়ে পড়ে কিশোরী। পরেরদিন ভোররাতে মৃত্যু হয় তার। ঘটনার পর ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়াই দেহ দাহ করে দেওয়া হয় বলেই অভিযোগ। অভিযোগ দায়ের হয় চারদিনের মাথায় গত শুক্রবার। তার ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে মামলাকারী যথেষ্ট প্রভাবশালী। তাই নির্যাতিতার পরিবারের কথা মাথায় রেখে এই ঘটনায় হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে। এই কারণ দেখিয়ে হাই কোর্টে দু’টি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়। সিবিআই তদন্তের দাবিও জানিয়েছেন মামলাকারীরা।
এদিকে, এই ঘটনার জোরকদমে তদন্ত করছে পুলিশ। ইতিমধ্যেই কিশোরীর প্রেমিক তথা তৃণমূল নেতার ছেলে সোহেল গোয়ালিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রানাঘাট মহকুমা আদালতে পেশের সময় সাংবাদিকদের জবাবে সোহেল জানায়, আমি কিছু করিনি। কিছু জানি না। প্রেমিক বলে আমাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তার দুই বন্ধুকে আটক করে চলছে টানা জিজ্ঞাসাবাদ। পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য। ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়াই কিশোরীর দেহ দাহ করা হয় বলে অভিযোগ। তবে ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া কীভাবে দেহ দাহ করা হল, তা এখনও জানা যাচ্ছে না। সে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শ্মশানকর্মী এবং এক হাতুড়ে চিকিৎসক সমীর কুমার বিশ্বাসের গোপন জবানবন্দি নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, গত ৪ এপ্রিল রাতেই নদিয়ার হাঁসখালির গ্যাড়াপোতা এলাকায় ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে। স্থানীয় তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের ছেলে সোহেল গোয়ালির জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে বীভৎস অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয় ওই কিশোরী। সোহেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল তার।
পরিবারের দাবি, জন্মদিনের পার্টির নামে ডেকে নিয়ে গিয়ে কিশোরীকে ধর্ষণ করে সোহেল। এক মহিলা আত্মীয়ার সাহায্যে বাড়ি ফেরে কিশোরী। সেই সময় থেকে প্রচণ্ড অসুস্থ ছিল সে। রক্তক্ষরণও হতে থাকে। ভোরের দিকে কিশোরীর জন্য ওষুধ আনতে যান পরিবারের সদস্যরা। তবে ততক্ষণে সব শেষ। প্রাণ যায় নাবালিকার। তবে সেই সময় কাউকে কিছুই জানাননি নিহতের পরিজনেরা। দেহ দাহ করে দেওয়া হয়।
অভিযোগ, তৃণমূল নেতার ছেলে সোহেলের পরিবারের তরফে দেহ দাহ করতে ক্রমাগত চাপ দেওয়া হচ্ছিল। তড়িঘড়ি দেহ দাহ না করলে প্রাণনাশের এবং বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় তারা। তাই ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়াই দেহ দাহ করে দেওয়া হয়। গত শুক্রবার হাঁসখালি থানায় সোহেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। আপাতত পুলিশের জালে তৃণমূল নেতাপুত্র।