শুধু কি আচমকাই বদলে গেল সভাস্থল? যে ভাবে সিপিএমের ছাত্র যুবরা পুলিশের নির্দেশ ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ধর্মতলায় কোনওরকমে অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে বিরাট সমাবেশ করলেন, সে জায়গাটি বহুকাল যাবদ তৃণমূলের একচেটিয়া, এখান থেকে একুশে জুলাইয়ের শহীদ সমাবেশ করে থাকেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এমনকি বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মমতা সিপিএমের পুলিশের বিরুদ্ধে এই ভাবেই চ্যালেঞ্জ করে সভা করেছেন। অনুমতি না দিলেও কার্যত ভয় পেয়েই বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ কোনও দিন ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সভা বন্ধের পদক্ষেপ নিতে পারেনি। মঙ্গলবারও মীনাক্ষীরা সেটাই করেই করে দেখালেন। এবং তৃণমূল সরকারের পুলিশের মুখ বুজে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। উল্লেখ্য,কয়েকদিন আগে কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনে মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, পুলিশ অনুমতি দেয়নি। কিন্তু ২০ সেপ্টেম্বর বাম ছাত্র-যুবদের ইনসাফ সভা ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনেই হবে। বস্তুত এদিন প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েই ছাত্র-যুবরা একটি চলমান গাড়িতেই সভা করেছে যাতে প্রয়োজন হলে জায়গা পরিবর্তন করা যায় সহজেই।

একুশের নির্বাচনে বাংলার বিধানসভা থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাওয়ার পর শূন্য থেকে ফিরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সিপিএম। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বামেদের ব্রিগেড সমাবেশ আক্ষরিক অর্থেই ‘দূরবীন দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না’ চালু এই প্রবাদটিকে মিথ্যে প্রমান করেছিল। গত লোকসভা ভোটের আগে, ৩ ফেব্রুয়ারিও বামেদের ব্রিগেডে মানুষের সমাগম দেখে বিরোধীরা চিন্তায় পড়েছিল। যদিও ভোটের ফলাফলে কার্যত ফাঁকা থলি হাতে দাঁড়ায় বামেরা। কিন্তু উপনির্বাচন ও পুর-নির্বাচনে ‘নো-পাত্তা’ সিপিএম ঘুরে দাঁড়ানো রাস্তার খোঁজ পায়। যে ঘুরে দাঁড়ানো একেবারে অনায়াস নয়। এই সময়ে সিপিএম দলের মধ্যে তরুণদের একটা বড়সড় সমাবেশ ঘটাতে পেরেছে। দলের নেতৃত্বে বা নীতিনির্ধারণেও তরুণদের ঠাঁই করে দিয়েছে। গত বিধানসভা ও পুরনির্বাচনে বেশিরভাগ আসনে তরুণদের প্রার্থী করা হয়েছিল। সিপিএমের তরুণরা সোশ্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি রাজপথেও ব্যাপক সক্রিয়। গত দুই দফা করোনার সময়ে সেখানে ‘রেড ভলান্টিয়ারদের’ তৎপরতা সবারই নজর কাড়ে। মাসের পর মাস ওরা কলকাতা ও আশপাশের এলাকায় গরিব মানুষের জন্য ‘শ্রমজীবী ক্যান্টিন’ চালিয়েছে। এসব তৎপরতা কলকাতাবাসীকে নিশ্চয়ই নাড়া দিয়েছে।

আরেকটি বিষয় অন্তত পুর-নির্বাচনে লক্ষ্য করা গিয়েছে- এক. সেখানে উদারপন্থি রাজনীতির স্পেসটা ছোট নয়। প্রয়োজনে শাসক ও বিরোধী উভয় দলই উদারপন্থি হতে পারে। অর্থাৎ বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক দলের জন্য সেখানে খুব বেশি স্পেস নেই। দুই. জনগণের সঙ্গে থাকলে একসময়ে জনগণ কর্তৃক পরিত্যাজ্য একটা দলও আবার উঠে দাঁড়াতে পারে। পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া সিপিএম সেই রাস্তাতে হেঁটেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে সফল হতে উদগ্রীব। উল্লেখ্য, ২০২১-এর পর বিজেপি আবার পিছু হটতে শুরু করে, কিছু ক্ষেত্রে বিজেপিকে সরিয়ে সিপিএম দু-নম্বরে উঠে এসেছে। আবার চন্দননগরের মতো জায়গায় তৃণমূলকে হারিয়ে পুর-নির্বাচনে জয়ীও হয়েছে সিপিএম। বালিগঞ্জের উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীকে লড়াইয়ের মুখে ফেলে দিয়েছিল সিপিএমই। ফলে সিপিএম অক্সিজেন পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে বাংলায়। এবার আসন্ন পঞ্চায়েত; তার আগে সিপিএম বৃহত্তর শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে তৃণমূল দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষতবিক্ষত। তাদের দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জেলে। অনুব্রত মণ্ডলের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতাকেও জেলে যেতে হয়েছে। তৃণমূলের আরও অনেকের বিরুদ্ধে কেলেঙ্কারির দাগ লেগে রয়েছে। এই অবস্থায় সরকারের দুর্নীতিকে ইস্যু করে গেমপ্ল্যান সাজিয়ে ময়দানে নেমে পড়েছে সিপিএমের ছাত্র-যুবরা।


সাতদিন আগেই বিজেপি নবান্ন অভিযান করে শক্তি প্রদর্শন করেছে। তারপর ধর্মতলায় আনিস খান থেকে শুরু করে সুদীপ্ত গুপ্ত, মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যু, বেকারত্ব এবং তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি-সহ একাধিক ইস্যুতে কলকাতার রাজপথে নামলো লালেরা। হাওড়া ও শিয়ালদহ থেকে মিছিলে লালে লাল হয়ে উঠলো ধর্মতলা। ‘ইনসাফ সভা’য় রাস্তায় নেমে বামেরা নিজেদের শক্তি দেখাতে পেরেছে, অন্তত পঞ্চায়েত নির্বাচনে আগে ভিড়ের লড়াইয়ে তারা গেরুয়াকে টেক্কা দিয়েছে। তবে কি লাল পার্টির সুদিন ফিরছে, ফের কি তার বাংলায় দাপট দেখাতে পারবে? ধর্মতলায় ইনসাফ সভার পর সিপিএম আশায় বুক বাঁধতে পারে। তাদের কর্মসূচিতে ছাত্র যুবাদের স্বতস্ফূর্ত উপস্থিতি তো সেটাই জানান দিলো৷ রাজনৈতিক বিশেষঙ্গদের কেউ কেউ বলছে, এত মানুষের উপস্থিতি, যার ফলে সভাস্থলই বদলে ফেলতে হল৷ এরা সবাইও যদি বামেদের ভোট দেয় তাহলেও তো শূন্যের আগে একটা এক বসে। কিন্তু তা কি হবে? তা নাহলে অতগুলি ভোট যাবে কোথায়? কারও কারও বক্তব্য, ১৫ বছর আগেও তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে এমন আক্ষেপ শোনা যেত৷ তিনিও বারবার বলতেন, তাঁর সভায় যারা আসেন, তাদের সকলের ভোট পেলেও তো সিপিএমকে হারানো যেত!
একুশে বাংলার মানুষ বিজেপিকে তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে মেনে নেয়নি। এখন তৃণমূলের দুর্নীতি প্রকাশ্যে, তখনও তাদের বিরুদ্ধে বহু প্রশ্ন ছিল। কিন্তু বামেরা পথে নামতে শুরু করে ২০২১-এ শূন্যে পৌঁছনোর পর, আনিস-কাণ্ডকে আঁকড়ে। তাঁদের আওয়াজকে আরও জোরদার করতে আনিসের সঙ্গে এবার সুদীপ্ত থেকে মইদুল, বেকারত্ব থেকে দুর্নীতি ইস্যুতে তারা তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে বিজেপিকে টপকে বিকল্প হওয়ার বার্তা নিয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে নামলো। ধর্মতলায় লাল পতাকার ঢেউ দেখে মীনাক্ষীদের কামব্যাকের স্বপ্ন দেখা শুরু, কিন্তু প্রশ্ন নিয়োগ দুর্নীতি দেখে ক্ষুব্ধ শিক্ষিত বেকার যুবারা কি আবার নতুন করে সিপিএমের পতাকা তলায় সামিল হবেন, সিপিএম কি তাদের উপর তিতিবিরক্ত বাংলার অগুনিত মানুষর আস্থা অর্জন করতে পারবে?
4 Comments
সিপিএম অক্সিজেন পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে বাংলায়। সেইমতো আসন্ন পঞ্চায়েতের আগে সিপিএম বৃহত্তর শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ধর্মতলায় ইনসাফ সভার পর অ্যাডভান্টেজ নিয়ে নিল সিপিএম, তৃণমূল যখন একের পর এক দুর্নীতিতে জর্জরিত। বিজেপিও নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছিল কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি ভিড় দেখিয়ে অ্যাডভান্টেজ নিয়ে নিল সিপিএম।
শূন্য ভোটবাক্স ভরতে সিপিএমের আগামী শতাব্দী পর্যন্ত শুদ্ধিকরণ দরকার, তবে কোটি কোটি টাকা চুরি আর দুর্নীতি যে পুলিশি ক্ষমতায় বলীয়ান শাসকের মানসিক শক্তিকে ঘুণ পোকার মত শেষ করে দেবেই। তার আগে কারা হাল ধরবেন এখন সেটাই সবথেকে বড় প্রশ্ন।
শূন্য আর অধিকাংশ তরুণ নেতা-নেত্রীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার ঘটনা থেকে ক্ষমতা দখল টিভি সিরিয়ালেও সম্ভব না। তবে দ্বিতীয় আর তৃতীয় জায়গার জন্য লড়াইটা হতেই পারে। আর লেখার শেষে যার ছবি, সিদ্দিকীর গুররা নেতৃত্বে থাকলে তো ইহজীবনেও তা সম্ভব না। লোকটার কোনো বিশ্বাসযোগ্যতাই নেই।