কলকাতা ব্যুরো: রামপুরহাটের ঘটনায় বড়সড় সিদ্ধান্ত নিল আদালত। বগটুই কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। পাশাপাশি রিপোর্ট জমা করারও সময়সীমা বেঁধে দিল হাইকোর্ট। আদালত সাফ জানিয়ে দিল, এই ঘটনায় সত্য উদঘাটন হওয়া প্রয়োজন।
রামপুরহাট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়ে শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্ট জানায়, বগটুইয়ের ঘটনায় আর কোনও তদন্ত করতে পারবে না রাজ্য সরকারের গঠিত SIT। সমস্ত অভিযুক্তদের সিবিআই-এর হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এখনও পর্যন্ত পাওয়া সমস্ত তথ্যপ্রমানও সিবিআই-কে দিতে হবে SIT-এর আধিকারিকদের। আগামী ৭ এপ্রিলের মধ্যে এই ঘটনার প্রাথমিক রিপোর্ট জমা করতে হবে সিবিআই-কে।
শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তাদের পর্যবেক্ষণে জানায়, রামপুরহাট বগটুইয়ের ঘটনা অত্যন্ত ‘শকিং’। বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা আছে। আর তাই এই ঘটনায় সত্য উদঘাটনের প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়াও জানানো হয়েছে, মানুষের মনে ভরসা জোগানো প্রয়োজন। স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে এই ঘটনার তদন্তভার সিবিআই-এর হাতে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, রাজ্য সরকারের তরফে জমা করা কেস ডায়রিও খতিয়ে দেখেছে ডিভিশন বেঞ্চ। মামলাকারীদের তরফেও আদালতে পেশ করা সমস্ত পয়েন্টগুলি শুনেছে ডিভিশন বেঞ্চ। এরপরই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।
কলকাতা হাইকোর্টের এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিএম সাংসদ তথা আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী প্রত্যেকেই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, এই রায় অত্যন্ত সংগত এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই রায়ের ফলে প্রশাসনিক ব্যর্থতাই স্পষ্ট হল।
রায়কে স্বাগত জানিয়ে বিজেপি মুখপাত্র সমীক ভট্টাচর্য্য জানান, শুধু আমরা নয়, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিশ্বাস করেন এই পুলিশ, সিআইডি বা সিট গঠন করে প্রকৃত সত্য উদঘাটন হবে না। বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতিতে স্পষ্ট যে পুলিশি তৃণমূল, তৃণমূল পুলিশ দুটি সম্পৃক্ত অবস্থায় রয়েছে। কেউ টিভি তত্ত্ব দিচ্ছেন আবার কেউ এসে সর্ট সার্কিটের তত্ত্ব দিচ্ছেন। রাজ্য পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা বলেই দিলেন এটার মধ্যে কোনো রাজনীতি নেই। এটার মধ্যে পার্সোনাল ভায়োলেন্স আছে, সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি। প্রমাণ লোপার চেষ্টা চলছে, প্রলেপের চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ তোলেন শমীক। তিনি জানান, আদালত পুরো বিষয় দেখেছেন এবং বুঝতে পেরেছেন যে এই পুলিশ, এই সিআইডি বা এই সিট দিয়ে কোনও দিনও নিরপেক্ষ তদন্ত সম্ভব নয়।
তবে শাসক দলের দাবি, পুলিশ যখন নিরপেক্ষ তদন্ত করছিল, তখন সিবিআই তদন্তের প্রয়োজন ছিল না। শুক্রবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে কুণাল ঘোষ বলেন, তদন্ত করুক আপত্তি নেই। কিন্তু, যদি বিজেপির বৃহত্তর ষড়যন্ত্রকে আড়াল করা হয়, তাহলে প্রতিবাদ করব আমরা। সিবিআই নিরপেক্ষ নয়, বলেই মন্তব্য করেছেন তিনি।
তবে তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে কার্যত প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিম ৷ রাজ্যের অন্যতম হেভিওয়েট মন্ত্রী ও কলকাতার মেয়রের বক্তব্য, আদালত আগে বলেছিল এদের (সিবিআই) তোতা পাখি। সিবিআই তদন্তে পক্ষপাতিত্ব হয়। এটা আমি না কোর্ট বলেছে। এই নিয়ে তাঁর আরও বক্তব্য, বারবার করে বলছি কোর্ট বলেছে, দেশের সবথেকে ভালো ভালো আধিকারিকরা আছেন সিবিআই, ইডি, এনআইএ-র মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থায়। তাঁদের নষ্ট করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ। তাঁদের নষ্ট করে দিচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের হস্তক্ষেপ। আমরা তো সম্প্রতি দেখতে পাচ্ছি সিবিআই কী করছে !
অন্যদিকে, এদিন আদালতের রায়ের পর মামলাকারীদের আইনজীবী বলেন, আমরা নিরপেক্ষ তদন্তের আবেদন জানিয়েছিলাম। যে জ্ঞানবন্ত সিংয়ের বিরুদ্ধে এতগুলি অভিযোগ রয়েছে, তাঁর নেতৃত্বে তদন্ত হলে তা নিরপেক্ষ হবে না। তথ্য লোপাটের আশঙ্কার কথাও আদালতে জানিয়েছিলাম। এরপরই আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন।
বগটুই কাণ্ডে ইতিমধ্যেই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। তবে তার আগেই হাইকোর্ট সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিকে নমুনা সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছিল। আর এই নির্দেশ অনুযায়ী শুক্রবার বগটুইতে পৌঁছলেন ফরেনসিক টিমের আধিকারিকরা। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলি থেকে নমুনা সংগ্রহ করলেন তাঁরা। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ CFSL-এর আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে যান। ওই দলে রয়েছেন রাসায়নিক, ব্যালিস্টিক বিশেষজ্ঞরাও।
কীভাবে আগুন লাগানো হয়, বাইরে থেকে পেট্রল বোমা ছোঁড়া হয়েছিল কিনা, এই সমস্ত নমুনা সংগ্রহ করার কথা বিশেষজ্ঞদের। এদিন সিবিআই আধিকারিকরাও ঘটনাস্থলে যান। শনিবার বগটুই গ্রামে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। এদিনই বগটুই কাণ্ডে ধৃত আনারুল হোসেনকে রামপুরহাট মহকুমা আদালতে তোলা হয়।
বগটুই কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। এসডিপিও সায়ন আহমেদও কর্তব্যে গাফিলতি করেছেন সে অভিযোগও নতুন নয়। ইতিমধ্যেই তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার একটি চিঠি ভাইরাল হয়। উপপ্রধান ভাদু শেখ যে আগেও প্রাণনাশের আশঙ্কা করেছিলেন, তা ওই চিঠিতে উল্লেখ করেছেন তিনি। উপপ্রধান এসডিপিওকে আশঙ্কার কথা জানালেও, কেন আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হল না, উঠছে সেই প্রশ্ন।
এদিকে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশের পরই বীরভূমের দিকে দিকে চলছে জোর তল্লাশি। ইতিমধ্যেই প্রায় ২০০টি তাজা বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। ছোট ডাঙাল গ্রামের ক্যানেলের কাছে ছ’টি ব্যারেলে বোমাগুলি রাখা ছিল। মাড়গ্রাম থানার পুলিশ বোমাগুলি উদ্ধার করেছে। ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে পুলিশ। খবর দেওয়া হয় বম্ব স্কোয়াডেও।