দিব্যেন্দু ভৌমিক
পাম্পু বস্তি । মূলত নেপালি জনজাতি অধ্যুষিত জনপদ। আছেন সাঁওতাল সহ অন্য কয়েক ঘর আদিবাসীও। জঙ্গল থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, ট্যুরগাইডের কাজ, পশুপালন ও চাষবাস এদের পেশা। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলের প্রবেশের মুখে বনবস্তিটি। তবে বক্সা বাঘ বনের এলাকার মধ্যেই এই বনবস্তি। আলিপুরদুয়ার থেকে ২০ কিমি । ১ কিমি পথ পাড় হলে রাজাভাতখাওয়া। তারপরেই বন দপ্তরের গেট পেড়িয়ে বক্সা বাঘ বন। বস্তির মুখে ছোট্ট একটি মোড়। বাজার। মানে পাঁচটি দোকান। তার মধ্যে একটি ‘বৌদির দোকান।’ সকাল থেকে রাত, অগুনতি মানুষের আনাগোনা এই দোকানে। ১৭ বছর ধরে দোকানটি চালিয়ে যাচ্ছেন বৌদি। ওঁর নামটা বৌদি সম্বোধনের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে। ভোটার তালিকায় নামটা টিকে আছে। গোমা ছেত্রী।

কী মেলে তাঁর দোকানে? এত মানুষের ভিড়ইবা কেন! চা, ঘুগনি -মুড়ি আর দই -চিঁড়ের দেদার বিক্রি। একবাটি ঘুগনি-মুড়ি ১৫ টাকা আর দই-চিঁড়ে ২০ টাকা। মালাই মারকে এক কাপ চা সাত টাকা। ফরেস্টার থেকে স্থানীয় মানুষ, আঠারোর কৈশোর থেকে প্রৌঢ়, সকলেরই প্রিয় ‘ বৌদির দোকান।’ একবার খেয়ে গেলে বার বার আসে। কেন? বৌদির সরল উক্তি, ‘জানি না। দেখবেন, আপনিও আবার আসবেন।’ মাটির নিকানো উনুনে ওঁর রান্না। এল পি জি গ্যাস উনি আনেননি দোকানে। টিনের ছাউনিতে, কাঠের পাটাতনে পথচলতি মানুষ আপ্যায়িত হন ‘ বৌদি ‘ র কাছে। ফিরে যান তৃপ্ত হয়ে।
পাম্পু বস্তি ও বৌদির দোকান কীভাবে যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছে। পাম্পু বস্তির ‘বৌদি’র পাশাপাশgি এখন আরেক বস্তিবাসীর নাম লোকের মুখে মুখে । এই দোকান থেকে একশ মিটার দূরত্বে এক যুবা এখন বস্তি, আলিপুরদুয়ার জেলা, রাজ্য, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে কড়া নেড়েছেন আমেরিকার দুয়ারে। তিনি নেত্রপ্রসাদ শর্মা। বন বিভাগের সাধারণ গাইড। পর্যটকরা এলে জঙ্গল ঘুরিয়ে দেখান, চেনান। কর্মস্থল রাজাভাতখাওয়া। আড্ডাস্থল এই বৌদির দোকান। ‘হ্যারিপটার ‘-এর নির্মাতা জে কে রাওলিংয়ের পরবর্তী উপন্যাসের
প্রধান চরিত্রে থাকবেন এই নেত্রপ্রসাদ! বাংলার যুবকের ঘরে হ্যারি পটারের রচয়িতা খোদ জেকে রাওলিংয়ের টেলিফোন এসেছিল।
কিছুদিন আগে নেত্রপ্রসাদ জানতে পারেন, জেকে রাওলিং তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। পাম্পু বস্তি থেকে আমেরিকা পর্যন্ত তাঁর পরিচয় পৌঁছে যাওয়ার নেপথ্যে আছে এক বছর আগের একটি ঘটনা। ৬ আমেরিকান ছাত্র -গবেষক এসেছিলেন বক্সা জঙ্গলে। তাঁদের গাইড ছিলেন নেত্র। তিনদিন ছিলেন তাঁরা বক্সা জঙ্গলে। জঙ্গল ও বন্যপ্রাণ সম্পর্কে নেত্রর গভীর জ্ঞান ও বিস্ময়কর ধারণা তাঁদের অভিভূত করে।
দেশে ফিরে যাওয়ারর আগে নেত্রকে নিয়ে এক ঘণ্টার একটি ভিডিয়ো করে তাঁরা নিয়ে যান। তাঁর পারিবারিক দুর্দশার কথা, দুই সন্তানকে নিয়ে খু্ঁড়িয়ে পথ চলা, জনজাতির পাশে থাকা ইত্যাদি সবই উঠে আসে ভিডিয়োতে। তারপর তো সব ইতিহাস! নেত্রকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘কতজনই তো আসেন। চলেও যান। অত কী মনে থাকে। কিন্তু ফোনে জখম জানলাম, হ্যারি পটারের রচয়িতা আমাকে নিয়ে একটি বই সম্পাদনা করেছেন, আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারিনি!’
নেত্রর এই যাত্রাপথ অনেক দীর্ঘ। গত ২৪ বছর ধরে বিশ্বের বেশ কিছু জনপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্র, গবেষকদের গাইডের কাজ করে চলেছেন নেত্রপ্রসাদ। কেউ টের পায়নি। নেত্রর বিশেষ গুণ, নিজের থেকেও বেশি ভালবাসেন জঙ্গলকে। বিভিন্ন সময়ে বন ও বন্যপ্রাণী নিয়ে খুব জটিল গবেষণাগুলিতে সাহায্য করেন দেশ-বিদেশের গবেষকদের। বর্তমানে বাঁদর নিয়ে কাজ করছেন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের সঙ্গে তার রাজাভাতখাওয়ায় যে বিতর্ক হয়েছিল, তা জানতে পেরে জেকে রাউলিংকে নেত্র সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করে।
বন ও বন্যপ্রাণীর আচরণ সম্পর্কে নেত্র কী জানেন, সেটা বড় প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল, নেত্র কী জানেন না। বাঘ, হাতি, পাখি, প্রজাপতি সম্পর্কে অদ্ভুত সব তথ্য তাঁর নখদর্পণে! হাতির পটি হাতে তুলে তিনি আলাদা আলাদা ভাগ করে বলে দিতে পারেন, সেদিন সকালে হাতিটি কী খেয়েছে। বলে দিতে পারেন, একটা বাঁদর মুখ থেকে ফলের বীজ ফেলে সারা জীবনে কত গাছের জন্ম দেয়। হর্ণবিল, বুলবুলিকে ট্যাগ বা হরিণকে রেডিওকলার সেই কবেই পড়িয়েছেন তিনি ।পুঁথিগত বিদ্যা কম। মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করতে পারেননি। কিন্তু নেত্র না থাকলে অনেক গবেষকই নাকি অথৈ জলে পরে যান, বৈচিত্র্যময় বক্সা বাঘ বনে এসে। নেত্রপ্রসাদ অবলীলায় সব ব্যাখ্যা করেন।
আরও অনেক কাজ আছে নেত্রর। রাতবিরেতে ওঁর ট্যুরিস্ট ভ্যান অ্যাম্বুল্যান্সে কনভার্ট হয়ে ছুটে চলে ২০ কিলোমিটার দূরে আলিপুরদুয়ারের হাসপাতালে। অবশ্যই একেবারে নিখরচায়। একটি ল্যাপটপ, একটি প্রজেক্টর থাকলে তিনি জেলার প্রতিটি স্কুলে যেতে চান। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চান বাচ্চাদের সঙ্গে।
তাঁর প্রতি রাউলিংয়ের আগ্রহ জানার পর নেত্র সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছেন জনপ্রতিনিধিরা। ছুটে গিয়েছেন আলিপুরদুয়ার জেলা পরিষদের মেন্টর মোহন শর্মা । খোঁজ নিচ্ছেন আলিপুরদুয়ারের বিধায়ক সৌরভ চক্রবর্তী এবং রাজ্যের অনগ্রসর কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন। ‘সরকার নেত্রপ্রসাদের পাশে আছে।’ জানালেন মন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন । বেজায় খুশি ওঁর বন্ধু তিতাস, বীরেন্দ্ররা । খুশি বৌদিও। ভিসা-পাসপোর্ট তৈরি। আর কয়েক মাস! করোনাকালের ইতি পড়লে বক্সা বাঘ বনের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ‘ উড়ে যাবেন ক্যালিফোর্নিয়ায়।