জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই কাটে সমুদ্রে। পৃথিবীতে তেমন এক উপজাতি রয়েছে, যাদের বসবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ জলরাশিতে। তারা ‘বাজাউ’ উপজাতি। প্রায় হাজার বছর ধরে এভাবেই জীবনযাপন করে যাচ্ছে বাজাউ উপজাতির জনগোষ্ঠী। আশ্চর্যের বিষয় এই উপজাতিরা কোনো দেশের নাগরিক নন। অবাঞ্ছিতের মতো এরা, নাগরিকত্বের সমস্ত অধিকার ছাড়াই যুগ যুগ ধরে জলেই জীবন কাটায়। বাজাউ উপজাতি বিশ্বের সবথেকে দক্ষ সাঁতারু। সমুদ্র শিকারের দক্ষতা থাকার ফলে এরা বেঁচে আছে। নৌকাতেই কাটছে এদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম, নেই কোনো শিক্ষা, সভ্য সমাজের সান্নিধ্যের সুযোগ। নাগরিকত্ব না থাকায় মেলে না কোনো সরকারি সুবিধাও। কাঠের নৌকাতেই কেটে যায় এদের ভাসমান জীবন। তাই এদের বলা হয় ‘সি জিপসি’ বা ‘সি নোম্যাড’।

অবিশ্বাস্য হলেও জলের নীচে তারা ১০ মিনিটের বেশি শ্বাস ধরে থাকতে পারে, যা প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এই উপজাতির অনেক মানুষ আছে, যারা মাটিতে কোনো দিন পা রাখেনি। যাযাবর এই জাতির সামুদ্রিক জীবন যাপনের নেপথ্যে রয়েছে এক করুণ বাস্তবতা। প্রায় হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোহর রাজ্যের রাজার বিশাল নৌবহর চলেছিল সমুদ্রপথে। রাজকন্যা দায়াং আয়েশাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সুলু রাজ্যের রাজার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য। রাজকন্যাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল দুঃসাহসী উপজাতি বাজাউ। এই এলাকার সমুদ্র যাদের নখদর্পণে ছিল। ব্রুনেইয়ের তৎকালীন সুলতান চেয়েছিলেন আয়েশাকে বিয়ে করতে; কিন্তু জোহরের রাজা তার মেয়ের সঙ্গে ব্রুনেইয়ের সুলতানের বিয়ে দিতে রাজি হননি। এই অপমান ভুলতে পারেননি ব্রুনেইয়ের সুলতান; মেনে নিতে পারেননি সুলুর রাজার সঙ্গে রূপসী আয়েশার বিবাহের উদ্যোগ। তাই ব্রুনেইয়ের সুলতান অতর্কিতে আক্রমণ করেছিলেন জোহর রাজ্যের নৌবহরে। গভীর সমুদ্রের জল বাজাউদের রক্তে লাল করে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন জোহরের রাজকন্যাকে। দেশে ফিরে আয়েশাকে বিয়ে করেছিলেন ব্রুনেইয়ের সুলতান। তার পরেই বিপদে পড়ে কয়েকশ বাজাউ ও তাদের পরিবার। দেশে ফিরলে জোহরের রাজা হত্যা করবেন। প্রাণের ভয়ে বাজাউরা আর দেশে ফিরতে পারেনি। ডাঙার সঙ্গে তাদের চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ ঘটে। সমুদ্রই হয়ে যায় তাদের ঘর। বাজাউরা ঘুরতে থাকে বিভিন্ন উপসাগরে, দেশহীন যাযাবর হয়ে।

প্রশান্ত মহাসগর ও ভারত মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত ব্রুনেই, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াকে ঘিরে বেশ কয়েকটি উপসাগর রয়েছে। যেগুলোর নাম সুলু, সেলেবিস, বান্দা, মালুকু, জাভা, ফ্লোরেস এবং সাভু উপসাগর। এই উপসাগরগুলোতে এক বিশেষ আকৃতির নৌকা লেপাতে চড়ে ঘুরে বেড়ায় বাজাউ উপজাতিরা। সমুদ্রের অগভীর এলাকায়, তীর থেকে আধা কিলোমিটার সমুদ্রের ভেতরে বাজাউরা তৈরি করে তাদের অস্থায়ী গ্রাম। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি বাড়িগুলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খুলে ফেলা যায়। বাড়িগুলোর নিচ দিয়ে সমুদ্রের ঢেউ বয়ে যায়। ছোট ছোট ডিঙির মতো নৌকা করে চলে এ বাড়ি-সে বাড়ি যাওয়া-আসা। জলের ওপরে বানানো হলেও ঘরগুলো কিন্তু পোক্ত। আশ্চর্যের বিষয় বাজাউরা নিজেদের বয়স বলতে পারে না। সময় কিংবা তারিখ সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। ঠিক যেমন তারা জানে না বিদ্যুৎ কী ও কেন লাগে। সমুদ্র-তীরবর্তী কিছু সহৃদয় গ্রাম এদের জ্বালানি কাঠ, জল এবং জামা-কাপড় দেয়; বিনিময়ে বাজাউরা দেয় মাছ।

অত্যন্ত শান্ত ও আমুদে এই উপজাতিটি সম্পূর্ণ সামুদ্রিক খাবারের ওপর বেঁচে থাকে। বছরের বেশিরভাগ দিনই তাদের সমুদ্রের নীচে নামতে হয় খাদ্য সংগ্রহের জন্য। তাই প্রত্যেকটি বাজাউ পুরুষ ও নারী দক্ষ ডুবরি। কাঠ ও ফেলে দেওয়া কাচ দিয়ে নিজেদের অপটু হাতে তৈরি করা জলনিরোধক চশমা চোখে পরে নেয়। যা জলের তলায় দেখতে ও চোখকে চাপ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। সঙ্গে নেয় নিজেদের বানানো অদ্ভুতদর্শন একটি কাঠের বন্দুক, যেটি দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে তির ছোঁড়া যায় জলের নিচে। এর পর বাজাউরা এক বুক শ্বাস নিয়ে খাদ্যের সন্ধানে নেমে যায় সমুদ্রের ২৩০ ফুট নীচে। জলের নীচে শিকার করে তাদের প্রধান খাদ্য- বিভিন্ন মাছ, স্টিং রে, স্কুইড, অক্টোপাস। উঠে আসার সময় শরীরে বাঁধা  ওজন খুলে ফেলে শরীরকে হালকা করে নেয়।

গবেষকরা জানিয়েছেন, বাজাউদের জিনে থাকা কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যই তাদের প্রাকৃতিক ডুবুরি তৈরি করেছে। বাজাউরা যখন শ্বাস চেপে জলে ডুব দেয় তখন তাদের দেহে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা দেয়। হৃদপিণ্ড তার কাজ কমিয়ে দেয়, অক্সিজেন বাঁচিয়ে রাখার জন্য। পালস রেট নেমে দাঁড়ায় প্রতি মিনিটে মাত্র ৩০ বার। গবেষকরা এও জানান, সামুদ্রিক পরিবেশে টিকে থাকার জন্য, শত শত বছর ধরে খাদ্য সংগ্রহের জন্য সমুদ্রের গভীরে যাওয়ার অভ্যাস, বাজাউদের বিভিন্ন অঙ্গ ও শ্বসনতন্ত্র এবং রক্ত সংবহনতন্ত্রে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তাই বাজাউরা সমুদ্রের জলে মাছের মতোই সাবলীল। অন্যদিকে ডাঙার খাবারে অভ্যস্ত হওয়ায় মোরো উপজাতির ডুব দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়ার তীর বরাবর সুলু সমুদ্রে যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। অসুস্থ হলেও তীর ছোঁয়ার উপায় নেই। নাগরিক না হওয়ায় ডাঙায় এলে কোনো দেশের হাসপাতাল চিকিৎসা করবে না। পুলিশ গ্রেপ্তার করে ফেলে রাখবে জেলে, বিনা বিচারে। তাই জন্মের মতো বাজাউদের মৃত্যুও হয় সমুদ্রে। নৌকায় দূর সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয় মৃতদেহ। সমুদ্রের পুত্র-কন্যারা সামুদ্রিক জীবের খাদ্য হতে হতে সমুদ্রগর্ভেই বিলীন হয়ে যায়।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version