লোকসভা ভোটের এখনও দু’বছর বাকি, তার আগে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনকেই কার্যত সেমিফাইনাল ধরা যায়। সেই লক্ষেই এগোচ্ছিল গেরুয়া শিবির পাশাপাশি বিরোধী দলগুলি নিজের মতো করেই চলছিল। এদিন সেমিফাইনালের ফলাফলে পদ্ম শিবিরের বিপুল সাফল্য ২৪-এর ফাইনালের আগে তাদের বাড়তি অক্সিজেন জোগাল।

ফলাফলের স্পষ্ট ছবিতে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস সবকটি রাজ্যেই প্রায় ধরাসায়ী। পাঁচ রাজ্যের মধ্যে উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, গোয়া, মণিপুরে গেরুয়া ঝড়। একমাত্র পঞ্জাবে পাঞ্জাবে ৭০ বছর পর ইতিহাস সৃষ্টি করল আপ। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল আম আদমি পার্টি কংগ্রেসের থেকে পঞ্জাব ছিনিয়ে নিয়েছে। তবে বাকি চার রাজ্যে মোদী-শাহ-নাড্ডার চওড়া হাসি। উল্লেখ্য, উত্তরপ্রদেশে গতবারের তুলনায় এবার আসন সংখ্যা কমলেও ফের একবার দুই তৃতীয়াংশ আসনে জিতে উত্তরপ্রদেশে আগাম হোলি খেলতে শুরু করেছে বিজেপি। গো-বলয়ের সবচেয়ে বড় এই রাজ্যে যোগী আদিত্যনাথেই ভরসা রেখেছে মানুষ।


অন্যদিকে যে রাজ্যে বরাবরই মজবুত ঘাঁটি ছিল কংগ্রেস এবং শিরোমণি অকালি দলের, সেই পঞ্চ নদীর তীরে বাঘা বাঘা প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করে ৭০ বছর পর অরবিন্দ কেজরিয়ালের নেতৃত্বে আপ পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হল। পাঞ্জাবে এবারের ভোটের লড়াই ছিল অনেক বেশি তাৎপর্যময়। এখানে কেউই বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়তে রাজি ছিল না। তাছাড়া ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে ১১৭টি আসনের মধ্যে যারা পেয়েছিল মাত্র ২০টি আসন সেই আপের কাছে একের পর এক কংগ্রেসের হেভিওয়েট প্রার্থী চরণজিৎ সিং চান্নি থেকে শুরু করে নভজ্যোত সিং সাধু পরাজিত হয়েছেন। একেই বলে ইতিহাস সৃষ্টি। তবে বুথ ফেরত সমীক্ষাতেও আপ সবাইকে পিছনে রেখেছিল।


সৈকত রাজ্য গোয়ায় বিজেপি সংখ্যা গরিষ্ঠতা না পেলেও বৃহত্তম দল হিসেবে সরকার গঠনের পথে। শতাংশের নিরিখে গোয়া বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি এবার পেয়েছে ৩৩.৪০ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস রয়েছে ঠিক তারপরেই। তারা পেয়েছে ২৩.৩৩ শতাংশ ভোট। তৃণমূল কংগ্রেসের জোটসঙ্গী মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টি পেয়েছে ৭.৭০ শতাংশ ভোট, আপ পেয়েছে ৬.৭৮ শতাংশ ভোট। এরপরের স্থান তৃণমূল কংগ্রেসের, তাদের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ ৫.২৩ শতাংশ। উল্লেখ্য, গত ৬ মাস ধরে তৃণমূল গোয়ায় কার্যত মাটি আঁকড়ে পড়েছিল। দফায়-দফায় গোয়া উড়ে গিয়েছেন তৃণমূলের বিভিন্ন নেতারা। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার উড়ে গিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না। ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে তৃণমূল জোট গোয়ায় পেয়েছে ২টি আসন। কেজরির দল আপও পেয়েছে ২টি আসন। কাজের কাজটি করে দেখাল বিজেপি, সমুদ্র রাজ্যে ফের একবার সরকার গঠন করছে তারাই।


গেরুয়া ঝড় বয়ে গিয়েছে উত্তরাখণ্ডেও। এ রাজ্যে ৭০ সদস্যের বিধানসভায় বিজেপি পেয়েছে ৪৮টি আসনে। বিজেপি এখানে বিপুলভাবে জিতলেও পরাজিত হয়েছেন বিজেপি-র মুখ্যমন্ত্রী পুস্কর সিং ধামি। ফলে নতুন কাউকে মুখ্যমন্ত্রী মনোনীত করে সরকার গঠন করবে বিজেপি। উল্লেখ্য, গতবারের তুলনায় কংগ্রেস ভালো ফল করলেও আসন পেয়েছে ১৮টি। ফলে তারা  বিজেপি-কে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাতে পারেনি। বিএসপি উত্তরপ্রদেশের তুলনায় উত্তরাখণ্ডে ভালো ফল করেছে।
মণিপুরেও গেরুয়া দাপটে ছন্নছাড়া বিরোধীরা। ৬০ আসনের বিধানসভায় ম্যাজিক ফিগার ৩১। বিজেপি ৩১টি আসনে জয় পেয়ে মণিপুর বিধানসভাটি নিজেদের দখলে রেখেছে। ২০১৭ সালে মণিপুর বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস পেয়েছিল ২৮টি আসন, বিজেপি ২১টি। পরে বিজেপি এনপিপি, এনপিএফ ও এলজেপিকে নিয়ে সরকার গড়তে সমর্থ হয়েছিল। এবারের বিধানসভা ভোটে বিজেপি এককভাবেই লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ৬০টি আসনেই প্রার্থী দেয়। কংগ্রেস সিপিআই, সিপিআই(এম), ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি ও জনতা দল (সেক্যুলার)-কে নিয়ে জোট গড়ে ভোটে লড়তে নেমেছিল। কিন্তু এই জোটের ভরাডুবি হয়েছে।


পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলাফলে দেশের মানচিত্র গেরুয়াময়। উত্তরপ্রদেশ থেকে শুরু করে মণিপুর দেশের সব প্রান্তেই গেরুয়া শিবিরের জয়জয়কার। হিসাব অনুযায়ী দেশের মোট ১২টি রাজ্যে বিজেপি এককভাবে ক্ষমতায় রয়েছে। আরও ৬টি রাজ্যে ক্ষমতায় আছে বিজেপির জোটসঙ্গীরা। মাত্র দু’ টি রাজ্য কংগ্রেসের রয়েছে দখলে। আর তিনটি রাজ্যে ক্ষমতায় আছে কংগ্রেসের জোটসঙ্গীরা। ২টি রাজ্য আম আদমি পার্টির দখলে। একটি করে রাজ্যে ক্ষমতায় আছে তৃণমূল, টিআরএস, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, বিজেডি।
স্বাধীনতার পর বহুকাল পর্যন্ত দেশে একমাত্র কংগ্রেসকেই সর্বভারতীয় দল হিসাবে ধরা হত। অনেকদিন পর্যন্ত বিজেপিকেও শুধু উত্তর ভারতের দল বলে মনে করা হত।

কারণ বিজেপি ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত উত্তর ভারতের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। এমনকি অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনও নয়। কিন্তু ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর কংগ্রেসকে সরিয়ে সব হিসাব বদলে বিজেপি সর্বভারতীয় দলের জায়গাটি দখল করে নিয়েছে, একমাত্র দক্ষিণ ভারত ছাড়া। কংগ্রেস আজ প্রান্তিক শক্তি। গেরুয়া ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছে আঞ্চলিক দলগুলি। তবে পাঁচ রাজ্যের মধ্যে চার রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল বুঝিয়ে দিল ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে অ্যাডভান্টেজ পজিশনে থাকলো বিজেপি।
Share.

5 Comments

  1. surbek bandopaddhaya on

    শুধু পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচন নয় সর্বভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে আম আদমি পার্টি নতুন এক রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করবে বলে মনে হচ্ছে।

  2. subrata chowdhury on

    এককালের সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস আজ আঞ্চলিক দলের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে অন্যদিকে কিছুকাল আগেও যাদের সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কোনও মর্যাদা ছিল না
    তারা দক্ষিণ ভারত ছাড়া সর্বত্র বিরাজ করছে, এর জন্য কংগ্রেসের দায় সবথেকে বেশি।

  3. manoranjan biswas on

    বুথ ফেরত সমীক্ষা পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টিকে এগিয়ে রেখেছিল, উত্তরপ্রদেশেও এগিয়ে রেখেছিল বিজেপিকে। যোগী উত্তরপ্রদেশে রেকর্ড করলেন, পাঞ্জাব বাদে অন্য চার রাজ্যে বিজেপির এই বিপুল জয় আগামী লোকসভা নির্বাচনে মোদীর ফিরে আসাকে নিশ্চিত করে দিল।

  4. ranabir lahiry on

    কলকাতা বা বাংলার মতো বিজেপি বিরোধিতা দেশের আর কোথাও নেই, বাংলা বিজেপিকে ঠেকিয়েছে বলে সারা দেশ ঠেকাবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। কেবল উত্তরপ্রদেশ নয় পঞ্জাব ছাড়া অন্য রাজ্যগুলি প্রমাণ করে দিল আগামী লোকসভায় বিজেপি ফিরছে।

  5. janakinath sen shastri on

    প্রায় প্রত্যেকটি বুথ ফেরত সমীক্ষা বলেছিল উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ফিরছে। সাধারণত ওই সব সমীক্ষা সব সময়ে ঠিক হয়না কিন্তু এবার মিলেছে। যোগী দ্বিতীয়বার ফিরে এসে রেকর্ড
    করলেন। অনেকেই বিজেপির এই প্রত্যাবর্তন আশা করেন নি, করার কথাও নয় কিন্তু সেটাই ঘটলো।

Leave A Reply

Exit mobile version