প্রথম পর্ব

কর্ম শেষে নববর্ষে বাবু ঘরে আসে।হাতে মিষ্টি এসেন্স শিশি আর পাঁজি পাশে। এককালে এই ছড়াটি খুব প্রচলিত ছিল। গ্রাম মফসসল থেকে অনেকেই চাকরি বা রোজগারের জন্য কলকাতায় আসতেন, থাকতেনও। ছুটিছাটায় বাড়ি ফিরতেন সংসারের খুঁটিনাটি সামগ্রী কিনে নিয়ে। কিন্তু বছর শেষে বাঙালিবাবুটি যখন বাড়ি ফিরতেন তখন নতুন বছরের উপহার হিসাবে যাই কিনুন না কেন ভুলতেন না একটি পাঁজি কেনার কথা। গৃহিণী ছাড়াও কাকিমা, পিসিমাদের অমাবস্যা, পূর্ণিমা, একাদশী তো বটেই তাছাড়াও অন্য অনেক তিথি-ক্ষণ মনে রাখতে হত তাঁদের। পঞ্জিকা ছাড়া আর কেইবা তাঁদের সেসব মনে করাতে পারে। কেবল কি তাই, কবে কখন যাত্রা করলে নির্ঝঞ্ঝাট হবে, সদর আদালতের মামলার শুভক্ষনের খবর তো পঞ্জিকাতেই মিলবে। এমনকি বাতের ব্যথা হঠাৎ বাড়ল কেন, সামনে কি অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমা? চট করে ঠাকুরের কুলুঙ্গি থেকে পাঁজিটা নামিয়ে চোখ বুলানোই ছিল রীতি। যেন পঞ্জিকাই বদ্যির বিধান আবার অভিভাবকও বটে! অন্নপ্রাশন থেকে বিয়ে, বাড়িতে নতুন অতিথির আগমন থেকে গৃহপ্রবেশ সবকিছুরই তো একটি শুভদিন চাই, সেই শুভ দিনটির হদিশ পাঁজি ছাড়া আর কে দিতে পারে?

বাঙালির নববর্ষ এবং পয়লা বৈশাখ নিয়ে বহু মতামত আছে, কেউ বলেন আগে পয়লা বৈশাখ বলে কোনো উৎসব ছিল না, কয়েক দশক আগে এই উৎসব শুরু হয়েছে। তবে একথা ঠিক যে পয়লা বৈশাখ থাকুক বা না থাকুন পঞ্জিকা ছিল। কেবল তাই নয়, একটা সময় ছিল যখন হিন্দু-মুসলমানের বাড়িতে পঞ্জিকা পড়ার চল ছিল৷ এমনকি যাঁরা পঞ্জিকা কিনতে পারতো না, সেই বাড়িতে গিয়ে পঞ্জিকা পড়ে আসতেন গ্রামের যে বাড়িতে পঞ্জিকা কেনা হত সেই বাড়ির গৃহকর্তা। তিনি হিন্দু না মুসলমান এই নিয়ে ধর্মবিচার খাটতো না। তাছাড়া সেই সময় এতসব ভাগাভাগি ছিল না। প্রসঙ্গত, ‘পঞ্জিকা’ কিন্তু ইংরেজিতে ‘অ্যালম্যানাক’-এর হুবহু বঙ্গীয় রূপমাত্র নয়। ‘পঞ্জিকা’ শব্দটি বাংলা ভাষায় এসেছে সংস্কৃত থেকে এবং বার, তিথি, নক্ষত্র, করণ ও যোগ-এই পাঁচটি বিষয়ের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এখানে। সব ধর্মের বাঙালির ধর্মীয় আচারাদি এবং দিনক্ষণের খুঁটিনাটি হিসাবের এই পুস্তকটি বহুকাল ধরেই বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। বাঙালি মানসে পঞ্জিকা পাকা আসন নিয়ে বসে আছে মুদ্রণযন্ত্র আসার আগে থেকে। তখন হাতে লেখা পঞ্জিকা, সংকলনের কাজটি করতেন পণ্ডিতেরা। হাতে লেখা পঞ্জিকাও তখন বিক্রি হত। সেই হাতে লেখা পঞ্জিকা বা ‘পাঁজি’ জমিদারবাড়িতে খোলা মাঠে পণ্ডিত মশাইরা পাঠ করে শোনাতেন। তারা গ্রহ বা নক্ষত্রভিত্তিক আগামী দিন সম্পর্কে বার্তা এবং নতুন বছরের ব্রত-পার্বণ, কৃষিকাজে করণীয় বা ব্যবসা-বাণিজ্যের হালচাল জানাতেন।

তাহলে বাংলা পঞ্জিকা প্রথম মুদ্রিত হল কবে? গবেষক চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ১৮১৮ সালে জনৈক রামহরি প্রকাশিত ১৫৩ পৃষ্ঠার একটি পঞ্জিকার কথা। কলকাতার স্যান্ডার্স কোম্পানি থেকে ছাপা হলধর বিদ্যানিধির পঞ্জিকা সংকলনের কথা জানা যাচ্ছে নগেন্দ্রনাথ বসু সংকলিত বিশ্বকোষ-এ। যদিও এই দুটি পঞ্জিকার কোনো খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত সবথেকে পুরনো বাংলা পঞ্জিকা ধরা হয় কলকাতা জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত দুর্গাপ্রসাদ বিদ্যাভূষণের ১২২৫ বঙ্গাব্দে সংকলিত পঞ্জিকাটিকে। উল্লেখ্য, ১৭৭৮ সালে হ্যালহেডের লেখা বাংলা ব্যাকরণ ছাপা হয়েছিল হুগলির জন অ্যানড্রুজের ছাপাখানায়। বাংলায় এটাই প্রথম ছাপা বই ধরা হয়, যদিও বাংলা ভাষা জায়গা পেয়েছিল ইংরেজির সঙ্গে। এরও চল্লিশ বছর পর ছাপা হয় প্রথম বাংলা পঞ্জিকা। প্রকাশক জোড়াসাঁকোর দুর্গাদাস বিদ্যাভূষণ, ছাপা হয়েছিল শোভাবাজারের বিশ্বনাথ দেবের ছাপাখানা থেকে। তবে মুদ্রণযন্ত্রের প্রসার ঘটলে অলভ্য, দুর্লভ এবং অতি প্রয়োজনীয় পঞ্জিকা সাধারণের নাগালে আসে বটতলাকেন্দ্রিক বাঙালি প্রকাশকদের সৌজন্যে।

দুর্গাদাসের পঞ্জিকাটি নাকি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, তাই  পরের বছরও দুর্গাদাস আরেকটি পঞ্জিকা প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে অনেকেই পঞ্জিকা প্রকাশ করতে লেগে পরে। কলকাতার বটতলায় পঞ্জিকার হাটও বসে এবং প্রতিবছরই প্রকাশকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এগুলির মধ্যে উল্লেখের দাবীদার শ্রীরামপুরের ‘চন্দ্রোদয়’ ছাপাখানা থেকে  কৃষ্ণচন্দ্র  কর্মকারের ‘নতুন পঞ্জিকা’। তাঁর ‘নতুন পঞ্জিকা’ নামকরণেই পঞ্জিকা নতুন এক মাত্রা পায়। এই রকম নামকরণের কারণ যাতে প্রতি বছর মানুষ এই পঞ্জিকা কিনতে উৎসাহী হয়, ফলে ব্যবসায়িক সাফল্য মেলে। দেখাদেখি আরও কিছু প্রকাশক ‘নতুন পঞ্জিকা’ নামে পঞ্জিকা প্রকাশ করে। নতুন বছরের পঞ্জিকা পয়লা বৈশাখের আগেই বাজারে চলে আসতে থাকে। ক্রমে পঞ্জিকায় ছুটির তালিকা, জেলাভিত্তিক মেলার বিবরণ, প্রতি মাসের কৃষি কাজের বিবরণ, আদালত-সংক্রান্ত নানা তথ্য, বাংলার বিভিন্ন প্রধান রোগের বিবরণ এবং সেগুলোর প্রতিকারের ব্যবস্থা ইত্যাদি। একসময় রেলের ভাড়াও পঞ্জিকায় যোগ হয়। জেমস লঙের তথ্য অনুসারে, স্যান্ডার্স কোম্পানি ১৮৪৬ সালে একটি পঞ্জিকা বের করেছিল, যার মুদ্রণসংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার। দশ বছর পর তারাই সেই পঞ্জিকা বিশ হাজার ছেপেছিল। জেমস লঙের দেওয়া হিসাব, ১৮৫৭ সালে শুধু কলকাতা শহরেই বিক্রি হয়েছিল এক লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার কপি পঞ্জিকা। বিক্রি বাড়তে থাকায় কমেছিল পঞ্জিকার দাম। ১৮২৫-এ যে পঞ্জিকার দাম ছিল এক টাকা, তিরিশ বছর পর তার দাম দাঁড়ায় মাত্র দু’আনা।

(চলবে)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version