ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক কি কেবলমাত্র রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের নাকি মানবতার এবং সাংস্কৃতিক আত্মীয়তার? ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের শিকড় কেবল গভীর নয়, এটি একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ভাষা এবং ঐতিহ্যের মিশেলে গড়ে ওঠা। যুগ যগান্ত ধরে এই অঞ্চলের মানুষ একসঙ্গে উৎসব পালন করেছে, পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে যা সীমান্তের দু’পারেই প্রসারিত। সু’দেশের সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য অভিন্ন ঐতিহ্য দুই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। এই অভিন্ন পরিচয় একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতি বাড়ায় এবং স্থায়ী বন্ধুত্বের ভিত্তি স্থাপন করে। কিন্তু আজ বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে সে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হোক কিংবা গ্রেপ্তারের ঘটনা তার জেরে কিন্তু সংঘর্ষ, মৃত্যু, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার, মন্দির আক্রমন, ঘর বাড়িতে হামলা ইত্যাদি চলছে। এর পাল্টা বেশ উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে কিছু দায়িত্বহীন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই পক্ষেরই উত্তেজক কথাবার্তার চাপান-উতোর দেখা যাচ্ছে। দুই দেশেই ক্ষোভ ও রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পরস্পরের পতাকার অবমাননা করা হয়েছে। রাজপথে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদী কর্মসূচিতেও কোনো দেশই পিছিয়ে নেই। পরিস্থিতি এখনো শান্ত হয়নি।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে দু’ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখি আমরা। অনেকেই দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত হয়ে প্রতিবাদ জানানোর দায়িত্ব পালন করেন। আবার অনেকেই উত্তপ্ত পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে দলীয় স্বার্থ হাসিল করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। তবু আশার কথা হল, দুই পক্ষেই ধীরে ধীরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতির পক্ষে কথাবার্তা চালানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। একথা বলাই বাহুল্য যে দু’দেশের সাধারণ মানুষ হিন্দু মুসলমান ধর্মনির্বিশেষে চান আইন তার নিজস্ব নিয়মে সুবিচারের পথে চলুক, পরিস্থিতির প্রতি নজর রেখে স্পর্শকাতর অনুষঙ্গ বিবেচনা করতে এবং যে কোনো ধরনের সমস্যার দ্রুত নিস্পত্তি। অন্যদিকে মুসলিম এবং হিন্দু–বৌদ্ধ–খ্রিষ্টধর্মনির্বিশেষে বড়-ছোট সব নাগরিকের কাছে প্রত্যাশা হবে দেশের স্বার্থ ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা এবং দেশ ও জাতির উন্নত ভবিষ্যৎ তৈরির দায়িত্বকেই অগ্রাধিকার দেওয়া। অবশ্যই নানা বিষয় নিয়ে তাঁদের এবং সম্প্রদায়ের নানা মানুষের মনে অনেক উদ্বেগ ও ক্ষোভ থাকতে পারে। বাস্তবতা বলছে, থাকাই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে বলার বিষয় হল, মূলধারায় সংশ্লিষ্ট-সম্পৃক্ত থাকলে নিজেদের উদ্বেগ ও ক্ষোভের কারণগুলো ক্রমেই মূলধারার আলোচনায় ও বিবেচনায় আনা যাবে।

ক্ষমতার কেন্দ্রে দরবারের চেয়ে জনগণের অর্থাৎ সামাজিক পর্যায়ে আলাপ-সংলাপের পরিসর তৈরি করাই জরুরি এবং তাতেই সব পক্ষেরই উপকার হবে বেশি। এ কথার ধারাবাহিকতায় বলা দরকার, ধর্মীয় ভিন্নতার ভিত্তিতেই পৃথক ধর্মীয় সংগঠন থাকতে পারে, কিন্তু সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণ, বিশেষত তরুণ সমাজ, যেন এগুলোয় আটকে না থাকে। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভালোমন্দ বিবেচনায় নেওয়া এবং তাদের স্বস্তিতে ও আশ্বস্ত রাখার মূল দায়িত্ব কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর। মহাত্মা গান্ধী উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিশেষ ও বাড়তি দায়িত্বের কথা এভাবেই ব্যক্ত করেছিলেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ যেহেতু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ, তাই এখানে মুসলমানদের দায়িত্ব বেশি। প্রসঙ্গত, উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিমের দীর্ঘ জটিল সম্পর্কের বিষয়টাও মনে রাখতে হবে। এটাও বলে নেওয়া ভালো যে পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে হিন্দুসমাজ রাষ্ট্রের কাছ থেকে নাগরিক হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠের তুল্য সমমর্যাদা পায়নি। আবার হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের যে দীর্ঘ জটিল ইতিহাস, তার মধ্যে উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে মুসলিম মানসে বর্ণহিন্দুর কাছ থেকে প্রাপ্ত অবমাননা, বৈষম্য ইত্যাদির যে ক্ষত রয়েছে, তাকেও উপেক্ষা করা যাবে না।

সাধারণভাবে মনে করা হয়, আওয়ামী লীগ আমলে হিন্দুরা ভালো থাকে; ঐতিহাসিকভাবে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া, তারা এ দলের ভোটব্যাংক হিসেবেই ভূমিকা নিয়ে এসেছে। আওয়ামীলিগের প্রকাশ্য রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বয়ান নেই, তাদের আমলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল পদেও এদের সংখ্যা বেড়েছিল, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এই অনুকূল আচ্ছাদনের আড়ালে হিন্দুদের বাড়ি, জমি বা মন্দির-মঠের জায়গা দখলে আওয়ামীলিগের নেতারাই বেশি অগ্রণী ছিলেন। তলিয়ে দেখলে এটাও বলতে হবে, আওয়ামীলিগ আমলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের যে অধ্যায়ের কথা বলা হয়, তা আদতে ছিল দুই সরকার এবং উভয় দিকের সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দু’দেশের নাগরিক সমাজের মধ্যে আলাপ-সংলাপ, ভাববিনিময়ের তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল না। কিন্তু দু’দেশের সম্পর্কের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নে এ রকম উদ্যোগই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দেশকে এটাও মনে রাখতে হয়, যেন দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো রকম অবিচার বা হামলা না হয়। কেননা, দু’দেশের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিন্যাস ধর্মের ভিত্তিতে বিপরীত হওয়ায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে উভয় দেশের সংখ্যালঘুরা চাপের মধ্যে পড়ে যায়।

ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান এবং সমাজে উগ্র হিন্দুত্বের চর্চা বাংলাদেশকে স্বভাবতই উদ্বেগে রাখে। কারণ, ধর্মীয় উগ্রবাদের মাধ্যমে অন্যান্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটে, যার প্রতিক্রিয়া পড়ে প্রতিবেশী দেশে। ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙা বা নতুন করে অন্যান্য মসজিদ নিয়ে বিতর্ক ওঠায় বাংলাদেশের মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনা আর হিন্দুদের মধ্যে ভয় ও শঙ্কা তৈরি হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে হিন্দুধর্মীয় নেতা গ্রেপ্তার হওয়া ও তাঁর জামিন না হওয়াতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ঘটেছে ভারতে। দু’দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়ায় উত্তেজনার পারদ বেড়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এ ধরনের পরিস্থিতিতে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে আর দুই দিকই যুক্ত হয় ধর্মীয় মূল্যবোধ ছাপিয়ে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতায়। কিন্তু কোনোরকম উগ্রতাই তো আমরা চাই না, অসহিষ্ণুতাও নয়, সাম্প্রদায়িকতা তো নয়ই। তাই কোনো রকম উসকানি ও উসকানিমূলক মন্তব্যকে প্রশ্রয় নয়। উত্তেজনার পারদ নামিয়ে সমঝোতার পথ তৈরি করাই দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বড় পদক্ষেপ বলে গণ্য হবে। কেননা, প্রতিবেশী পরিবর্তনের সুযোগ সংশ্লিষ্ট কোনো দেশেরই নেই।
