পৃথিবীর কত সাম্রাজ্য বহু বছর আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেই ভূখণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বী রাজারা দখল করেছিল, তাদের কাছ থেকে আবার তাদের শত্রুরা তা ছিনিয়ে নিয়েছিল। এই জয় আর পরাজয়ের ভাঙাগড়ার খেলা নিয়েই এগিয়েছে ইতিহাস। কিন্তু অনেক সাম্রাজ্য এবং সম্রাট রয়েছেন যাদের কীর্তি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দখল করতে পারেনি, চিরস্থায়ী স্বীকৃতি হিসেবে রয়ে গিয়েছে। যেমন প্রাচীন অ্যাসিরীয় সভ্যতার অন্যতম সম্রাট আসুরবানিপাল আমলের গ্রন্থাগার। প্রাচীন পৃথিবীতে যেকটি সাম্রাজ্য বিস্তীর্ণ এলাকা শাসন করেছিল, তাদের মধ্যে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য অন্যতম। মেসোপটেমিয়ার টাইগ্রিস নদীর তীরবর্তী শহর আশুর বর্তমানে উত্তর ইরাক-কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সভ্যতা থেকেই অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের সূচনা। খ্রিষ্টের জন্মের ৩ হাজার বছর আগে থেকেই এই অঞ্চলে সভ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে ঐতিহাসিকদের ধারণা, ১৭৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে “আশুর”প্রথমবার শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অ্যাসিরীয় রাজারা বিভিন্ন সময় প্রতিবেশী রাজ্যের উপর হামলা চালিয়ে কখনও জয় বা কখন পরাজিত হয়েছেন। ধীরে ধীরে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকে এবং সমকালীন অন্যান্য জাতির আগেই তারা লৌহ নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রযুক্তি তাদের সেনাবাহিনীতে প্রচলন করে।

অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য তার উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছায় রাজা আশুরবানিপালের সময়। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি অ্যাসিরীয়ান সাম্রাজ্যের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। আশুরবানিপালের নিয়ন্ত্রণে ছিল মেসোপটেমিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল ব্যাবিলন, পার্সিয়া ও সিরিয়া। মিশরের উপরও তার আধিপত্য সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও দূরদূরান্তের অনেক রাজাই নিজেদের সিংহাসন রক্ষা করার জন্য তাকে নিয়মিত উপঢৌকন পাঠাতেন। আশুরবানিপাল যেমন প্রজাদের প্রতি ছিলেন সদয়, তেমনি শত্রুদের প্রতি তার নিষ্ঠুরতা কিংবদন্তি হয়ে আছে। তিনি অ্যাসিরীয়ান সাম্রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী “নিনে-ভ”-কে তৈরি করেছিলেন সমকালীন পৃথিবীর প্রধান শহর হিসেবে। তার সময়ে নিনেভের মতো বড় এবং জৌলুশপূর্ণ শহর খুব বেশি ছিল না। তবে অ্যাসিরীয় সম্রাট আশুরবানিপাল স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর রাজকীয় গ্রন্থাগারের জন্য। বিংশ শতাব্দী পর্যন্তও এটিকে মনে করা হত সবথেকে পুরাতন লাইব্রেরি, যদিও পরে প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে এর থেকে পুরনো লাইব্রেরি আবিষ্কৃত হয়। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, আশুরবানিপালের লাইব্রেরি সম্ভবত ইতিহাসের প্রাচীনতম রাজকীয় গ্রন্থাগার এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বইয়ের শ্রেণীবিন্যাস করার দিক থেকে পৃথিবীর প্রথম। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, যদি আশুরবানিপালের লাইব্রেরি না থাকতো তাহলে তিনিও অনেক রাজার মতো ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে যেতেন।

সেই সময়কার অনেক রাজার বিদ্যার দৌড় যেখানে ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, সেখানে আশুরবানিপাল রীতিমত লিখতে পড়তে পারতেন। তিনি “কিউনিফর্ম স্ক্রিপ্ট” নামে সুমেরিয়ান এবং আক্কাদিয়ান লেখনী রপ্ত করেছিলেন, এবং অন্যান্য প্রাচীন ভাষাতেও তার দক্ষতা ছিল উল্লেখ করার মতো। শিল্প-সাহিত্যেও ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ এবং এর পৃষ্ঠপোষকতা তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হত। ঠিক কখন তিনি তাঁর লাইব্রেরির পরিকল্পনা করেছিলেন তা সঠিকভাবে বলা যায় না, তবে ধারণা করা যায়, তার শাসনকালের পুরোটা জুড়েই তিনি এর সংগ্রহশালা বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। আশুরবানিপাল তাঁর অধীনে সমস্ত শাসকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদের রাজ্যের যত লিখিত গ্রন্থ আছে সমস্ত তার কাছে পাঠিয়ে দিতে। তার সময় অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের বিস্তার থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, তার এই রাজকীয় আদেশের ফলে বহু প্রাচীন লেখনী তার লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছিল। সেই সময় লেখার জন্য মাটির চতুষ্কোণ ব্লক, বা ট্যাবলেট ব্যবহার করা হত। আশুরবানিপাল নিজেই এরকম অনেক মাটির ট্যাবলেট রচনা করেন যার শেষে তিনি স্বাক্ষর করতেন “আশুরবানিপাল, অ্যাসিরিয়ার সম্রাট, পৃথিবীর সম্রাট”।

সম্রাট আশুরবানিপালের রাজকীয় প্রাসাদের দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তর অংশের দ্বিতীয় তলার পুরোটা জুড়ে ছিল লাইব্রেরি।সেই বিশাল লাইব্রেরি দেখাশোনার জন্য আলাদা লোক ছিল। এছাড়াও সমস্ত সংগ্রহ করা বইকে বিষয়বস্তু অনুসারে আলাদা আলাদা করে সাজানো হয়েছিল। যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞান, ভাষা ও ব্যাকরণ সংক্রান্ত রচনা, কিংবদন্তি ও লোককাহিনী, ধর্মীয় গ্রন্থ, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা, গ্রহ নক্ষত্রের গতিপথ বিষয়ক লেখা ইত্যাদি।প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা কক্ষ নির্দিষ্ট করা ছিল এবং প্রতিটি কক্ষের সংগ্রহের আলাদা আলাদা তালিকা করা থাকতো। এছাড়াও সমস্ত সংগ্রহের একটি পরিপূর্ণ তালিকাও ছিল। আধুনিককালে আমরা যে লাইব্রেরি ক্যাটালগ দেখতে পাই, এক অর্থে আশুরবানিপাল তার সূচনা করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তিনিই ইতিহাসে প্রথম হিসেবে “বুক কার্স”-এর অবতারণা করেন। লাইব্রেরির বই চুরি ঠেকাতে প্রত্যেকটি বইতে চোর ধ্বংসের দেবতার অভিশাপ ঘোষণা করা হয়েছিল।

আনুমানিক ৬৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আশুরবানিপালের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সাম্রাজ্য দখল ঘিরে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অনেক রাজ্য আলাদা হয়ে যায়। শত্রুদের হাতে রাজধানী নিনেভের পতন হলে পরাক্রমশালী অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের সমাপ্তি হয়। অ্যাসিরীয়দের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ থেকে শত্রুরা নিনেভকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। লাইব্রেরি চাপা পড়ে সম্রাটের রাজকীয় প্রাসাদের জ্বলন্ত দেওয়ালে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ মিউজিয়াম নিনেভ খনন করে এই লাইব্রেরির সন্ধান পান। লাইব্রেরিতে বিশাল সংগ্রহের কথা জানতে পেরে পৃথিবী অবাক হয়ে যায়।
