একটি পাহাড়ের কোলে রয়েছে চারটি গ্রাম। কম বেশি সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের বাস ওই চারটি গ্রামে। ওই গ্রামগুলির প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের জীবন সরাসরি নির্ভরশীল ওই পাহাড় ও পাহাড়ি বনের উপর। পুরুলিয়া জেলার হুড়া ব্লকের অন্তর্গত কলাবনী পঞ্চায়েত এলাকার ওই চারটি গাম হল তিলাবনী, লেদাবনা, পড়শিবনা এবং মাধবপুর। আর চার গ্ৰামের মাঝে মাথা তুলে আছে তিলাবনী পাহাড়। জানা গিয়েছে রাজ্য সরকার ২০১৯ সালে গ্রানাইট উত্তোলনের জন্য এই তিলাবনি পাহাড়কে তুলে দিয়েছেন একটি বেসরকারি সংস্থার হাতে। লকডাউনের জন্য কিছু দিন কাজ বন্ধ ছিল। সম্প্রতি আবার কাজ শুরু হবে বলে কথা।
কিন্তু গ্রামের মানুষ তিলাবনী পাহাড় বিক্রি হতে দেবেন না। তিলাবনী শুধুমাত্র একটি পাহাড় নয়, এটি গ্রামবাসীর জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। তাছাড়া এই পাহাড় এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ভরকেন্দ্র। গত কয়েক বছর ধরে তিলাবনী পাহাড় রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। প্রতি বছর এ রাজ্যের বহু প্রতিষ্ঠিত প্রকৃতিপ্রেমী, পাহাড়প্রেমী সংগঠন এখানে কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে শৈলারোহণ ও প্রকৃতি পাঠের শিবির করে থাকে। রক ক্লাইম্বিং স্পোর্টসেও এখনএই পাহাড় অত্যন্ত জনপ্রিয়। গত ডিসেম্বর মাসে এখানে জাতীয় স্তরের ‘বোল্ডার ক্লাইম্বিং উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়েছে।বিগত কয়েক বছরে গ্রামের বহু ছেলেরা এই রক-ক্লাইম্বিং দলগুলির সঙ্গে গাইডের কাজে যুক্ত হয়েছে। এখন এই পাহাড় কেটে ফেললে সেই সমস্ত গ্রামবাসীদের পেটে কোপ পড়বে, তাঁদের জীবিকা ধ্বংস হবে।

এছাড়াও চারটি গ্রামের মানুষের জীবন সরাসরি এই পাহাড়ি বনের উপর নির্ভরশীল। গ্যাসের দাম যে হারে বাড়ছে গ্রামের গরিব মানুষের পক্ষে গ্যাস কেনা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তার বদলে তাঁরা বনের থেকে কাঠ নিয়ে আসে জ্বালানির জন্য।তাই এই পাহাড় ধ্বংস হোক তা স্থানীয়রা কোনও মূল্যে মেনে নেননি। প্রতিবাদে জোট বেঁধেছেন, তথাকথিত শিল্পের নামে তিলাবনী ধ্বংস করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে সোচ্চার হয়েছেন। পাহাড় বিক্রি প্রকল্প বাতিলের জন্য আগেও গণস্বাক্ষর করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একইসঙ্গে রাজ্যের সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন প্রকৃতিপ্রেমী সংগঠন ও ব্যক্তির কাছেও পাশে থাকার আহববান জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা।


একথা আজ সকলেরই জানা যে পাহাড় কেটে বন জঙ্গল উজাড় করার ফলে পরিবেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।পাহাড়ের গাছ-পালা অবাধে কেটে ধ্বংস করে ফেলায় অনেক বন্য পশু পাখিদ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে, প্রাণী জগতের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও গ্রামাঞ্চলে যেসব বন্য পশু-পাখি দেখা যেত পরিবেশের বিরূপ প্রভাবে আজ তারা হারিয়ে গিয়েছে। তাছাড়া পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছপালা ধ্বংসের ফলে পাহাড়ের মাটি আগলা হয়ে যায়।তার ফলে ভুমি ধ্বস হয় এবং মাটির অণুজীব বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।পাহাড়ের গায়ে জন্মানো বন-জঙ্গল ও গাছপালা এর অভ্যন্তরীণ বন্ধন মজবুত রাখে। পাহাড় কাটার কারণে সেই বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে।
সরকার এসব বিষয় খুব ভাল করেই জানে। কিন্তুতা স্বত্বেও তাঁরা প্রাকৃতিক সম্পদ বেঁচে দিতে চাইছেন কেন? এই বেচা কেনার ক্ষেত্রে রাজ্য ও কেন্দ্রের ভূমিকা প্রায় একই। পুরুলিয়ার তিলাবনী পাহাড়ের প্রসঙ্গে এসে পড়ে দিঘার সমুদ্রসৈকত। কয়েক বছর আগেচোখের নিমেষে বিক্রিহয়ে গেল দিঘার মোহনা থেকে নিউ দিঘা ছাড়িয়ে উদয়পুর পর্যন্ত গোটা সমুদ্রসৈকত। স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদে সামিল হল। তাঁদের আটকাতে তৈরী হল প্রায় ৬৫০টি দোকান।বিভিন্ন শর্তে সেই দোকানগুলির বরাত পেলেন স্থানীয় মানুষরা। এককালীন টাকা, মাসিক ভাড়া, শাসকদলের মিটিং মিছিলে সামিল হওয়া ইত্যাদির বিনিময়ে সমুদ্র সৈকত জুড়ে যে হাজার হাজার ঝাউ গাছ ছিল রাতারাতি তা কেটে পুরো সাফ হয়ে গেল। ঝাউবনের জায়গায় এখন সিমেন্টের মেঝে, চায়ের দোকান, মোমো, আইস ক্রিম এর দোকান; সরকারি পরিভাষায় একে বলে সৌন্দর্যায়ন।

তাজপুর তো অনেকদিন আগেই ধ্বংসের পথে চলে গিয়েছে। মন্দারমণীর হোটেল গুলির বারান্দা যেন সমুদ্রের জলেই তৈরী করা। পর্যটকরা রুম লাগোয়া বারান্দাতেই বসে সমুদ্রস্নান করে প্রায়। নিউ দিঘার সমুদ্র সৈকতে কয়েকশো নীল সাদা গুমটি। সারি সারি আট তলা, ন’তলা হোটেল। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে অধিকারী স্মৃতি সৌধ বা দিঘা ডেভেলপমেন্ট অথরিটির জাহাজ বাড়ি। শাসকদলের বিরাট নেতা ওই জাহাজবাড়ি যা দিঘা ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান থাকাকালীন তৈরী করিয়েছিলেন। বেথুয়াডহরী, পারমাদ্বনের জঙ্গলও অত্যন্ত দূরাবস্থায়। কুলীক পাখিরালয়তে বিষ মাখানো তীর আর মশারির জাল নিয়ে শিকার চলে। পর্যটক আবাসে সন্ধ্যে হলেই ডিজেসাউন্ড বক্সের আওয়াজে কান ফাটে। পরিবেশ নিয়ে রোজই প্রায় সেমিনার চলে কিন্তুসমুদ্র সৈকত, বন বিক্রি হয়ে যায়,বালির জন্য নদীর পারও বিক্রি হয়ে যায় সরকারের চোখের সামনে।
এবার সরকার নিজেই একটু বেশি টাকার জন্য আস্ত একটা পাহাড় কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে।দেখে শুনে মনে হয় চুরির যেন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। গরিবদের চাল যদি চুরি করে বেঁচে দেওয়া যায়, পাড়ার সমাজসেবী কাউন্সিলর পেশিশক্তি দেখিয়ে প্রোমোটারের থেকে তোলা আদায় করতে পারে, ত্রাণের ত্রিপল চুরি করে যদি বেঁচে দেওয়া যায়, পার্টি অফিস হবে বলে গরিবের পাঁচিল ভেঙে যদি জমি দখল করা যায় তাহলে আস্ত একটা পাহাড় কেটে বিক্রি হবে না কেন?
3 Comments
তথাকথিত শিল্পের নামে সরকারের নিয়মনীতিহীন কৌশল এখানে খাটবে না। ‘পাহাড় বাঁচাও গণ আন্দোলন’ সজাগ আছে। কোনও মূল্যে মানুষ পাহাড় কেটে গ্রানাইট তুলতে দেবে না।
এ রাজ্যে মানুষের প্রাণ থেকে শুরু করে যথাসর্বস্ব লুঠ হচ্ছে বহুকাল সম্প্রতি শুরু হয়েছে সরকারি সাহায্যে খনিজ সম্পদ লুঠ। তবে তার বিরুদ্ধে দিকে দিকে গণ আন্দোলন গড়ে
উঠছে। কারণ এর সঙ্গে মানুষের জীবন জীবিকা জড়িয়ে আছে।
ওই পাহাড়ে রয়েছে কত ধরণের গাছপালা, পাহাড় ঘিড়ে হাজার মানুষের পেট চলে, এখানে শীতে পর্যটকরা ভীড় জমান, সরকার সেই পাহাড়কে বিক্রি করে দেবে আর মানুষ তা
মেনে নেবে? সরকার নদী-নালা, সমুদ্র সৈকত, জঙ্গল সব বেঁচে দিচ্ছে, প্রকৃতি পরিবেশকে মারছে এবার মারবে মানুষ। আর কত রকম চুরি বাকি থাকছে?