মহাকুম্ভ শুরু হওয়ার পর প্রথম দুর্ঘটনা আগুন, ১৯ জানুয়ারি মহাকুম্ভে বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড ঘটে, গ্যাসের সিলিন্ডার ব্লাস্ট করে। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত মঙ্গলবার ঘটে পদপিষ্টের ঘটনা। এরপর বৃহস্পতিবার ফের কুম্ভের প্রাঙ্গনে অগ্নিকান্ড, সেক্টর ২২-এ আগুন লেগে ১৫টি তাঁবু পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। মঙ্গলবার প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভে মৌনি অমাবস্যার স্নানের জন্য ভীরের হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় ৩০ জনের, আহতের সংখ্যা ৯০ জন। উল্লেখ্য, মহাকুম্ভে পদপিষ্ট হয়ে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে উত্তর প্রদেশের যোগী সরকার কিন্তু বুধবার বিকেল পর্যন্ত কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দুপুরেই নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেন।

একদিকে হতাহতের বিষয় নিয়ে উত্তর প্রদেশ রাজ্য প্রশাসন নীরব থেকেছে অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন’। তিনি এও বলেন, কেউ গুজবে কান দেবেন না। তিনি সংগমস্থলে যাওয়ার চেষ্টা না করে সবাইকে নিকটবর্তী ঘাটে স্নান করতে বলেন। উত্তর প্রদেশ রাজ্য প্রশাসনের নীরবতা এবং মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, নিহত ও আহতের সংখ্যা জানাতে তাঁর প্রশাসন অনিচ্ছুক বলেই ওই বিষয়টিতে সরকার অনুচ্চারিত থাকে। কেবল তা–ই নয়, পদপিষ্টের দুর্ঘটনায় কেউ যে মারা গিয়েছে, সেই তথ্যও যোগী বা তাঁর সরকার স্বীকার করতে নারাজ। অথচ দুপুরে প্রধানমন্ত্রী মোদীর শোক প্রকাশে বোঝা যায় দুর্ঘটনায় অনেকেই হতাহত হয়েছেন। তাছাড়া তাঁর শোকবার্তার মধ্যে এও বোঝা গেল যে অন্য অনেক ঘটনার মতো এই দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজেপি সরকার একমত নয়। পাশাপাশি এটাও ঘটনা অত লোকের হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়ে ৩০ জন নয়, অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

১৯ জানুয়ারি কুম্ভের মেলায় যে অগ্নিকাণ্ড ঘটে তার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নীরব থেকেছেন। পরবর্তীতে প্রয়াগরাজে মৌনী অমাবস্যার পুণ্যতিথিতে স্নানের জন্য অতিরিক্ত ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হওয়ার কারণ ও হতাহতের সংখ্যা নিয়েও নির্বাক থেকেছেন। কারণ, মহাকুম্ভের ঘটনা যাতে কোনোভাবেই তাঁর বিরুদ্ধে না যায়, সেটা তাঁকে যেনতেন নিশ্চিত করতেই হবে। তাছাড়া কেন্দ্র ও রাজ্যে বিজেপি সরকারের আমলে এই প্রথম উত্তর প্রদেশে মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ আগেই জানিয়েছিলেন ৪০ কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ মহাকুম্ভে আসবেন। তার জন্য যে মহা আয়োজন তা নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক স্বার্থে। সেই উদ্দেশ্য যথাযথ ভাবে সফলের চেষ্টায় তিনি কোনো রকম ত্রুটি রাখতে চাননা। কিন্তু প্রশ্ন কী কারণে প্রধানমন্ত্রীর শোকবার্তা বুঝিয়ে দিল যে যোগী আদিত্যনাথ স্পষ্টতই দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করতে চাইছেন।

তাই কেন ঘটল এমন ভয়ঙ্কর বিপর্যয় সেই প্রশ্ন অনেক বিরাট আকার ধারণ করেছে। প্রসঙ্গত, শুরু থেকেই বোঝা গিয়েছিল এবার কুম্ভে অন্যান্যবারের ভিড়ের রেকর্ড ধূলিসাৎ করে দেবে, বিশেষ করে প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভে মৌনি অমাবস্যার স্নান, এই বিশেষ দিনে যে প্রায় ১০ কোটি পুণ্যার্থীর সমাগম হতে চলেছে সেটাও আগে অনুমান করা গিয়েছিল, তাহলে কী সেই ভিড় সামাল দেওয়ার মতো ব্যবস্থা শুরু থেকেই নেওয়া হয়নি? মুখ্যমন্ত্রী যোগী নির্বাক থাকুন বা যাই বলুন না কেন নেওয়া জে হয়নি সে কথা বলাই বাহুল্য। উত্তর প্রদেশ রাজ্য প্রশাসনের তরফে মহাকুম্ভ মেলায় দর্শনার্থীদের জন্য বেশ কয়েকটি অস্থায়ী সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল৷ কিন্তু অমৃতস্নানের আগের তিন দিন থেকে ওই সেতুগুলি বন্ধ রাখা হয়েছিল। কেন? জানা যাচ্ছে সেতু বন্ধ রাখার কারণে সঙ্গম স্নান সেরে যেসব স্নানার্থী ঝুঁসি ও নৈনির অভিমুখে যাওয়ার চেষ্টা করে তারা সমস্যায় পড়েছিল। আর তার ফলেই কম সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় কয়েক কোটি মানুষের ভিড় জমে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়৷

জানা গিয়েছে এই বছর মহাকুম্ভ মেলার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নজরে রাখার জন্য এআই ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছিল৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই সমস্ত ক্যামেরা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়৷ দুর্ঘটনা রাতে ঘটায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীরা পরিস্থিতি কী হতে পারে তা আন্দাজ করতে পারেননি৷ দুর্ঘটনার পর পুলিশ আধিকারিকরা অ্যাম্বুল্যান্স ও গাড়ি নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করেন৷ দুর্ঘটনাস্থলটি ছিল সঙ্গম এলাকায়৷ যে এলাকায় মানুষ আসা ও যাওয়া করতে পারেন মাত্র একটি রাস্তা দিয়ে। একটিমাত্র রাস্তা ব্যবহার করারই ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ কোটি কোটি মানুয়াষের চলাচলের জন্য রাস্তা যদি মাত্র একটি হয় তাহলে খুব বড় কারণ ছাড়াই যে কোনো মুহুর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু একথা কী প্রশাসন জানত না? যাই হোক ভিড়ের চাপ বাড়তে দেখেও তারা পালাতে পারেন নি, কারণ সে সুযোগ তাদের ছিল না৷ ফলে, অতগুলি মানুষকে পদপিষ্ট হয়ে মরতে হয়েছে।

কুম্ভমেলার পাশে বিকল্প সেতু থাকলেও তা বন্ধ ছিল। মহাকুম্ভের জন্য এক বছর ধরে প্রস্তুতি চলেছে, তাও এত বড় দুর্ঘটনা। কেন, কাদের গাফিলতি? পুণ্যস্নানের জন্য কোটি কোটি মানুষের ভিড় কিন্তু তা সামাল দিতে কত পুলিশ, কেন তারা রাতের ভিড় সামলাতে ব্যর্থ হল? মহাকুমা শাসক জানাচ্ছেন, অনুমতি ছাড়াই বহু তাঁবু তৈরি হয়েছিল, স্থানীয় প্রশাসনের নজর এড়িয়ে বেআইনি তাঁবু তৈরি হল কিভাবে? রাস্তার দুধারে যথেষ্ট জায়গা না ছেড়ে হাজার হাজার দোকান গড়ে উঠলো কাদের অনুমতিতে? দু’দুটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কিভাবে, কেন দমকল যথাসময়ে ঘটনাস্থালে পউছতে পারলো না? এরকম আরও বহু প্রশ্ন প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভের মেলার বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কে দেবে উত্তর!
