কোনও কোনও গান শতাব্দী পেরিয়েও বেঁচে থাকে। দশকের পর দশক মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস বয়ে বেড়ায়, স্বাধীনতার ইতিহাসকে জীবন্ত রাখে। দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে, আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে জড়িয়ে যায়। তেমনই ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একুশের গান-'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'।গানটির রচয়িতা সদ্যপ্রয়াত আব্দুল গাফফার চৌধুরীও বাঙালির হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন কেবলমাত্র এই গানটির জন্যই।ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেএই গান গেয়ে প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত মানুষ শহীদ মিনার অভিমুখে খালি পায়ে হেঁটে যান এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
মুক্তি যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্ম নিলে ফরাসী দার্শনিক আঁন্দ্রে মারলো ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটির সুর শুনে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি দেশে ফেরার সময় একটি রেকর্ড সঙ্গে নিয়ে যান।বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান সেকথা শুনে গাফফার চৌধুরীকে দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ নিয়ে ঠিক ওইরকম একটি গান লেখার অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে গাফফার চৌধুরী জানান, তা কিভাবে সম্ভব,বঙ্গবন্ধু কি নিজে ৭ই মার্চের ভাষণের মতো দেশবাসীর সামনে আরেকটি ভাষণ দিতে পারবেন?বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দূর পাগল, তা কি আর সম্ভব?’ গাফফার চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু, আমার পক্ষেও কি আরেকটি একুশের গান লেখা আর সম্ভব?’ একুশের এই গান আজ আর কেবল বাংলাদেশের ২১-এর গান নয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিশ্বের ১৯৩টি রাষ্ট্রে এই গান গাওয়া হয়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকার জগন্নাথ হলের সামনে (তখন প্রাদেশিক আইন পরিষদ ভবন) গুলি চলে। গুলিতে প্রাণ হারায় রফিক। তার লাশ পড়ে থাকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহি:বিভাগের বারান্দায়। এ খবর পাওয়ামাত্র গাফফার চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম এবং শফিক রেহমান ছুটে আসেন। রফিকের লাশ দেখে গাফফার চৌধুরীর মনে শোকাবেগে গুঞ্জরিত হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। এরপরে গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয় বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেনের সঙ্গে। গাফফার বন্ধুকে তার মনে গুঞ্জরিত কবিতার লাইনটি শোনান। আহমদ হোসেন গাফফার চৌধুরীর হাত চেপে ধরে বলেন- এখনই লিখে ফেলুন। চৌধুরী বললেন- রাস্তায় দাড়িয়ে কি কবিতা লেখা যায়? গাফফারজানান, হোস্টেলে ফিরে গিয়ে লিখব।

তখন তিনি ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। তিনি থাকেন আরমানিটোলার ‘বান্ধব কুটির’ নামে ছাত্রাবাসে। সেখানে পৌঁছে দেখেন গেটে নোটিস ঝুলছে। সরকারের নির্দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ ও ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওই রাতেই ঢাকা কলেজের আরেকটি ছাত্রাবাস বেগম বাজারের‘নুরপুর ভিলা’য় শফিক রেহমানের কাছে গিয়ে উঠলেন। সেখানে কবিতাটির আরও কয়েকটি লাইন লেখেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি শোক র্যালিতে পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকের সঙ্গে গাফফারও আহত হন, পায়ে মারাত্মক ব্যথা নিয়ে তিনি ওঠেন সহপাঠী দাউদ খানের এক আত্মীয়ের বাড়ি। এরপর প্রবল ব্যথা ওজ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যালে। খবর পেয়ে আহমদ হোসেন হাসপাতালে আসেন এবং গাফফারের কাছে কবিতাটি চান। কিন্তু কবিতা তখনও পুরোটা লেখা হয়নি। আহমদ গাফফরের হাত চেপে ধরে বলেন, ‘আজই কবিতাটি শেষ করতে হবে’। ভাষা আন্দোলনের জন্য তারা একটি ইস্তেহার প্রকাশ করবেন।এখনই কবিতাটি দরকার। অবশেষে গাফফার চৌধুরী কবিতাটির লেখা শেষ করলেন।

এর কয়েকদিনের মধ্যেই প্রকাশিত হয় রক্তঝড়া ভাষা আন্দোলনের প্রথম ইশতেহার। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ছাপা হয় গাফফার চৌধুরীর কবিতা। গাফফার চৌধুরীর সহপাঠী অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের ছোট ভাই আতিকুল ইসলাম তখনকার প্রখ্যাত তরুণ রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। তিনি একুশের শহীদদের স্মরণে গাওয়া যায় এমন একটি গানের সন্ধান করছিলেন। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া ইশতেহারে গাফফার চৌধুরীর কবিতাটি দেখে তার পছন্দ হয় এবং তিনি আব্দুল লতিফের কাছে নিয়ে যান। আব্দুল লতিফ কবিতাটিতে সুরারোপ করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজে শহীদ দিবস এবং ছাত্র ইউনিয়নের অভিষেক অনুষ্ঠানে আতিকুল ইসলাম সর্বপ্রথম আব্দুল লতিফের দেয়া সুরে সেই গানটি গেয়েছিলেন। কিন্তু গান গাওয়ার অপরাধে আতিকুল ইসলামসহ অভিষেক অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা আরও দশ ছাত্র কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। এক দুর্ঘটনায় আতিকুল ইসলামের অকাল মৃত্যু ঘটে। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয় গানটি। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে।
গাফফার চৌধুরীকে বললেন, একুশের উপর লেখা তার গানটিতে তিনি নতুন করে সুর দিতে চান। গাফফার চৌধুরী জানান যে তাঁর আপত্তি নেই তবে আব্দুল লতিফ যেহেতু এই গানে প্রথম সুর দিয়েছেন তাই তার সঙ্গেও কথা বলা দরকার। একুশের গানটিতে আলতাফ মাহমুদ সুর দেওয়ার পরই গানটি একুশের প্রভাত ফেরির গানের মর্যাদা পায়। গানটিতে মোট ৩০ টি পঙক্তি থাকলেও প্রভাতফেরির গান হিসেবে প্রথম ৬ পঙক্তি গাওয়া হয়।১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষাশহিদদের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে যে গান তার সুরকার আলতাফ মাহমুদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান 'জীবন থেকে নেওয়া' ছবিতে এই গানটি ব্যবহার করেন।
3 Comments
খুব ভালো লেখা। সিকান্দার আবু জাফরের ‘আমাদের সংগ্রাম চলছে চলবে/জনতার সংগ্রাম চলছে’র ইতিহাস সবাই জানুক। ‘প্রয়োজন হলে দেব এক নদী রক্ত।
আপনার লেখায় সম্পূর্ণ তথ্য পেয়ে সমৃদ্ধ হলাম, অনেক ধন্যবাদ।
সত্যিই এতো বিশদভাবে জানতাম না এই ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগের ঘটনা। আপনাকে ধন্যবাদ।