বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অসংখ্য ঘরবাড়ি। কিন্তু কোনো একটি বাড়িতেই কোনো মানুষের বাস নেই। এমন ভাবেই পড়ে আছে তা প্রায় ৩০০ বছর ধরে। রাজস্থানের জয়সালমের থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার পশ্চিমে এই গ্রামটির নাম কুলধারা। কথিত মাত্র এক রাতেই জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল এই গ্রামটি। লোকে এও বলে, এই গ্রামে নাকি ভূতেরও দেখা মেলে। এক সময় এই গ্রামে পালিওয়াল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের বাস ছিল। কিন্তু ঠিক কি কারণে গ্রামটি এক রাতের মধ্যে জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল তার সঠিক কারণ সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত নয়। কারণ নিয়ে অনেক ধরনের গল্প প্রচলিত রয়েছে। অনেকটা ভোজবাজির মতো গ্রামের সমস্ত মানুষ এক রাতে উবে গিয়েছিল আর সেই সঙ্গে উধাও হয়ে গিয়েছিল গ্রামের শ্রী সমৃদ্ধী। তারপর থেকে ঘরছাড়া মানুষদের অভিশাপ বুকে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুলধারা গ্রাম।

১২৯১ সালে পালিওয়াল ব্রাহ্মণরা যে গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেছিল, ১৮২৫ সালের এক রাতে সেই কুলধারা গ্রামের সব মানুষ কিভাবে উধাও হয়ে যায়; কেউ বলেন, কুলধারার গ্রামবাসীদের কোনো এক যাদুকর অভিশপ্ত করেছিল, কারও মত, স্থানীয় জমিদাররা তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল, যে কারণে গ্রামবাসীদের অতৃপ্ত আত্মা এখনও গ্রামময় ঘুরে বেড়ায়। ইতিহাস বলছে, কুলধর গোত্রের পালিওয়াল ব্রাহ্মণেরা পালি নামের এক জনপদ থেকে এসে এখানে বসতি গড়েছিলেন। গ্রামটি ধীরে ধীরে এক সমৃদ্ধ নগরের চেহারা নিয়েছিল। মরু অঞ্চলের এই গ্রামে পুকুর কেটে, কুয়ো খুঁড়ে, পরিকল্পনামাফিক নদীর জল ব্যবহার করে কৃষিকাজ শুরু করেছিল তাঁরা। কঠোর পরিশ্রমে সবুজ করে তুলেছিল বন্ধ্যা ভূমিকে। বাইরে থেকে আসা মানুষদের গুণের মতো রূপের খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়েছিল সারা রাজস্থানে। আর কাল হয়েছিল সেটাই। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই সম্পদের জন্য মানুষের লোভই শেষ করে দিয়েছিল সমৃদ্ধ গ্রামটিকে। উনিশ শতকে নাকি জয়সলমির স্টেটের অত্যাচারী দেওয়ান সালিম সিং-এর কুনজর পড়েছিল গ্রামের মোড়লের অপূর্ব সুন্দরী মেয়ের উপর। মেয়েটিকে বিয়ে করার জন্য এক নোংরা চাল চেলেছিলেন দেওয়ান। কুলধারার জন্য অসম্ভব চড়া হারে খাজনা ধার্য করেছিল সে। আর তারপর গ্রামবাসীদের প্রস্তাব দেয়, হয় ওই মেয়েটিকে তাঁর হাতে তুলে দিতে হবে, না হলে ওই বিপুল পরিমাণ খাজনা দিতে হবে।

বিকেলে মেয়েকে বিদায় দেওয়া যাবে না, এই অজুহাতে সেদিনের রাতটুকু সময় চেয়ে নিয়েছিল গ্রামবাসীরা। আর সেই সুযোগেই, রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে গ্রাম ছেড়েছিল তাঁরা। পিছনে পড়ে ছিল তাঁদের ঘরবাড়ি, জমিজমা, মন্দির, শস্য ভাণ্ডার আর শ্রম-যত্ন-ভালবাসা দিয়ে গড়ে তোলা কুলধারা গ্রাম। পরবর্তীকালেও আর কোনো খোঁজই মেলেনি তাঁদের। সেই অসহায় মানুষগুলির চোখের জলই কুলধারা গ্রামকে অভিশপ্ত করে রেখেছে বলে বিশ্বাস করেন স্থানীয় মানুষেরা। এই পরিত্যক্ত গ্রামে বাস করতে গিয়ে অনেকে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন, এমনকি প্রাণও হারিয়েছেন বলে শোনা যায়। এমনকি ২০১০ সালে দিল্লির প্যারানরম্যাল সোসাইটির একটি দল এই গ্রামে এক রাত কাটিয়েছিল। তাঁদের একাধিক ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে বলেও দাবি করেছিলেন ওই দলের সদস্যরা। আর এই সব ঘটনা মিলিয়েই পাকাপাকিভাবে অভিশপ্ত গ্রামের তকমা লেগে গিয়েছে কুলধারা গ্রামের গায়ে। সেদিনের অসহায় পালিওয়ালদের ক্ষোভ হয়ত খানিক সুবিচার পেয়েছে এভাবেই, মনে করেন স্থানীয় মানুষেরা।

অনেকের দাবি, জনমানবহীন কুলধারায় ঘুরে বেড়ায় অতৃপ্ত আত্মা! সেখানে বসতি গড়ার চেষ্টা করলেও নানা ভৌতিক কাণ্ডকারখানার মুখে পড়তে হয়েছে। তবে জায়গাটি যাতে বেহাত হয়ে না যায়, সম্প্রতি সেই বন্দোবস্ত করেছে সরকার। ইদানীং তা ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া বা এএসআই)-এর অধীনে রয়েছে। টিকিট কেটে পর্যটকদের ঢোকার বন্দোবস্ত করেছে এএসআই। রহস্যের টানে কুলধারায় বহু পর্যটকই পা রাখেন। তাঁরা জানিয়েছেন, কুলধারায় সার সার ঘরবাড়ি এখনও প্রায় অক্ষত। কয়েকটি ঘরবাড়ির চাল উড়ে গেলেও মাটির দেওয়াল পড়ে যায়নি। তবে অনেকের সেখানে অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়েছে বলে দাবি। ১৮৯৯ সালে লক্ষ্মী চন্দের লেখা ‘তারিখ-ই-জয়সলমের’ বইটিতে কুলধারার বিষয়ে নানা তথ্য পাওয়া যায়। তাতে লেখা রয়েছে, এ গ্রামে কড়হান নামে এক পালীবাল ব্রাহ্মণ প্রথম বসবাস করতে শুরু করেছিলেন।

কুলধারায় অন্তত ৪১০টি ঘরবাড়ির প্রায় ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। সেই সঙ্গে তিনটি সমাধিক্ষেত্রও পাওয়া গিয়েছে। রয়েছে একাধিক কুয়ো। তবে তা থেকে জল ভরার লোকজন নেই। ৩০০ বছর আগেকার সেই বর্ধিষ্ণু গ্রাম থেকে রাতারাতিই নাকি লোকজন গায়েব হয়ে যায়। কেন? তা নিয়ে জনশ্রুতির অভাব নেই!
