এক নজরে

লোকস্মৃতিতে আদরণীয় ইতিহাসে বঞ্চিত বীরাঙ্গনা

By admin

September 26, 2023

ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাইয়ের নাম আমরা কিশোর বয়স থেকেই জানি ইতিহাস বই থেকে। কিন্তু রানীর রূপ ধারণ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আরও এক বীরাঙ্গনা, তাঁর নাম আড়ালেই পড়ে থাকে। কারণ ইতিহাসের কাহিনী নিয়ে যারা বই লেখেন তাঁরা তাঁকে দলিত সমাজের প্রতিনিধি বলে সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন। এমন মানসিকতার শিকার হলে কী হবে, তার সমাজের লোকেরা কিন্তু তাঁকে ভুলে যায়নি। তাই তিনি স্থান করে নিয়েছেন লোককাহিনীতে, লোকস্মৃতিতে এবং সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। ১৮৫৭ সালের বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী এই বীর রমণীর নাম ঝলকারিবাই।

মাত্র ২৭ বছর বয়সে ঝলকারিবাই স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন বাজি রাখেন। তিনি রানী লক্ষ্মীবাইয়ের নিয়মিত সেনাদলের একজন সদস্য ছিলেন। নারী সৈন্যদের নিয়ে রানী একটি বাহিনী গঠন করেছিলেন। স্বীয় রণকৌশল ও অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ হওয়ায় ‘দুর্গা দল’ নামের সেই বাহিনীর প্রধান ছিলেন ঝলকারি। প্রশ্ন, কে ছিলেন এই ঝলকারিবাই? ঝাঁসির রানীকে নিয়ে উপন্যাসে কেন তিনি এতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন? কেন দলিত সমাজের প্রতিনিধি হয়েও গ্রন্থপ্রণেতারা তাঁকে অস্বীকার করতে পারলেন না? আসলে ঝলকারিবাই হলেন উপমহাদেশের এমন এক বীর রমণী যিনি ঝাঁসির রানীর রূপ ধারণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজদের দ্বিধায় ফেলে দিয়েছিলেন।

আজ থেকে প্রায় ১৯২ বছর আগে ঝাঁসি থেকে চার ক্রোশ দূরে অবস্থিত এক ছোটো গ্রামের একটি গরিব পরিবারে তাঁর জন্ম। অল্প বয়সে তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। পিতা সদোবর সিং তাকে পুত্রতুল্য লালনপালন করেন এবং যুদ্ধকলা, হস্তীসওয়ারি, অস্ত্রচালনা প্রভৃতি শিক্ষা দেন। যে পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্তি ছিল অনেক দূরের বিষয়। কিন্তু নিজেকে তিনি অনন্য সাহসী, নির্ভীক ও দূরদর্শীরূপে প্রস্তুত করেন। তিনি এমন এক নারী যার বাহাদুরি ইতিহাসের দলিল-দস্তাবেজে স্থান না পেলেও সাধারণ জনতার হৃদয়ে ঠিকই স্থান পেয়েছে। গল্প-কাহিনী-উপন্যাস-কবিতার আকারে তিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান রয়েছেন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজও তার গল্প দলিত ও প্রান্তিক সমাজের মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা। তাই গোয়ালিয়র-সহ ভারতের কয়েকটি শহরে অশ্বারোহী ঝলকারিবাইয়ের মূর্তি আজও চোখে পড়ে।

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের কথা যখন যেখানে স্মরণ করা হয় ঝলকারির প্রসঙ্গ সেখানে আসবেই। কথিত যে ইনি ঝাঁসির রানীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন নিয়ে ইতিহাসে যেসব লেখা আছে সেখানে দলিত অন্ত্যজ সমাজ একেবারেই অনুপস্থিত। উত্তর ভারতের বুন্দেলখণ্ডের লোকস্মৃতিতে তাঁকে বীরাঙ্গনারূপে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। সেখানকার জনগণ মনে করে, শৈশব থেকেই এই নারী বীরোচিত ছিলেন। পূরণ নামঁরর নামের এক সাহসী মল্লযোদ্ধা ছিলেন তাঁর স্বামী। ঝাঁসির রানীর শিবিরে সৈনিক হিসেবে তিনি কাজ করতেন এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি শহীদ হন। হয়তো এই ঘটনাই তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঝলকারিবাইয়ের মতো এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিল।

রানী লক্ষ্মীবাই যখন তাঁর সম্পর্কে সম্যক অবগত হলেন তখন তারা দুজনে সহেলি বনে গেলেন। অনেকে বলেন, তাঁদের দুজন দেখতে একই রকম ছিলেন। অস্ত্রচালনায় দক্ষ ছিলেন বলে দুর্গাদল নামে রানীর নারী সেনাদলে তাঁর অভিষেক ঘটেছিল। ইতিহাস বলে, রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের নিধনের পর ইংরেজরা তাঁর স্থলাভিষিক্তকে স্বীকার করেনি। ফলে ইংরেজদের সঙ্গে বিরোধের কারণে রানী লক্ষ্মীবাই শাসন ব্যবস্থা নিজের হাতে তুলে নেন। সঙ্গে সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে তাঁকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে এমনটা ভেবে প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ চারপাশে ছড়াতে শুরু করল। উত্তর ও মধ্য ভারতে তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল। সিপাহিরা লক্ষ্মীবাইয়ের সমর্থনে একত্র হতে শুরু করল। ১৮৫৮ সালে যখন জেনারেল স্যার হিউ রোজ কামান নিয়ে ঝাঁসির রানীর ওপর হামলা করল এবং চারপাশ থেকে তাঁকে ঘিরে ফেলল তখন ঝলকারি ও তাঁর স্বামী সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধ করলেন। রানীকে প্রাসাদ ছেড়ে নিরাপদে চলে যেতে তিনি পরামর্শ দিলেন এবং নিজে যুদ্ধে আরও নিবিষ্ট হলেন।

এই গল্প বুন্দেলখণ্ডের লোকের মুখে মুখে ফেরে। আর এই ভাবে তিনি অমর শহীদরূপে ইতিহাসে জীবিত থেকে গিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে অনেক প্রজন্ম অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজে নয়, বরং সাধারণ মানুষের মনে আরও বেশি ঠাঁই করে নিয়েছেন তিনি। দলিত লোকেরাই কেবল তার ওপর ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যার অর্থ হলো, লোকের স্মৃতিতে তিনি ছিলেন, এখনো আছেন। সুতরাং ইতিহাসে তিনি নেই এ কথা বলা যায় না।কিন্তু প্রশ্ন হল, যেখানে আশপাশের ছোট-বড় অনেক রাজা এই যুদ্ধে ঝাঁসির রানীর হাতে হাত রাখেননি সেখানে অন্ত্যজ বলে যাদের মনে করা হয় তারা কেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে ঝাঁসির রানীর সঙ্গে একাত্ম হলেন বা কীভাবে হলেন? রানীই-বা এ কাজ কীভাবে করলেন, কেন করলেন?

ঝলকারিবাই যেহেতু এমন একটি পেশার সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন, তিনিও রানীর অন্দরমহলে কাজ করতেন। যারা এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ছিল। কথিত আছে, তিনি রানীর দাসী ছিলেন। তখন রানীর বয়সও সামান্য ছিল। তাঁর দাসীদেরও বয়স কম ছিল। কম বয়সী হওয়ায় তাঁদের সঙ্গে রানীর সদ্ভাব হওয়াই স্বাভাবিক। কথিত আছে, তাঁর মুখের গড়নও লক্ষ্মীবাইয়ের মতো ছিল। রানীর সঙ্গে ঝলকারিবাইয়ের যোগাযোগের কারণ হিসেবে দুটি বিষয়ের কথা বলা হয়। এক, সেবাকার্যের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা দুই, তাঁর স্বামীর রানীর সিপাহিশালায় নিয়োজিত থাকা। সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থার সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা থেকে লক্ষ্মীবাইয়ের চিন্তাধারা কিছুটা আলাদা ছিল। লক্ষ্মীবাই যথেষ্ট জনমুখী রানী ছিলেন। তাই তাঁর সঙ্গে ঝলকারিবাইয়ের দেখা হওয়ার বিষয়টি একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। ঔপন্যাসিক-কবি-নাট্যকারদের রচনায় ঝলকারিবাই সরব থাকলেও ইতিহাস গ্রন্থে আজও অনুপস্থিত। তবে অগণিত দলিত মানুষের মুখে মুখে তাঁর কাহিনী প্রচলিত আছে।