(দ্বিতীয় পর্ব)
মুদ্রিত আকারে বাংলা পঞ্জিকা প্রকাশের বয়স প্রায় দুশো বছর। দু-এক বছর কম বেশি হতে পারে। বয়স যাই হোক কালের পরিক্রমায় বাঙালির অতীত ঐতিহ্যের মধ্যে যে কটি বিষয় এখনও টিকে আছে, অবশ্যই পঞ্জিকা তার মধ্যে অন্যতম একটি। নতুন বাংলা বছরের শুরুতে বাঙালি এখনো পঞ্জিকা কেনার জন্য ব্যস্ত হয়, পুরনো বছর ফুরিয়ে আসতেই তার জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কেউ একথা বলতেই পারেন যে পঞ্জিকা তো বোঝাই করা কুসংস্কার আর অচল রীতিনীতির একত্রবাস। যদি তাই হয়, তবু বলতে হবে সেই পঞ্জিকা যে বাঙালির সামাজিক ইতিহাসের একটি বিরাট দর্পণ। রেভারেন্ড জেমস লঙ জানান, বইয়ের ক্ষেত্রে এক একটা সংস্করণ ছাপা হত পাঁচশো থেকে খুব বেশি হাজার কপি কিন্তু পঞ্জিকা একটি সংস্করণেই ছাপা হত অন্তত পাঁচহাজার কপি। তাঁরই দেওয়া হিসাব, বছরে কমবেশি একলক্ষ পঞ্জিকা বিক্রি হত। বলাই যায় যে পঞ্জিকা সেকাল থেকেই বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

একটা সময় থেকে পঞ্জিকা প্রকাশে অগ্রণী ভুমিকা নিয়েছিল বটতলা। বাংলা পঞ্জিকা প্রকাশের ক্ষে্ত্রে বটতলার অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। উনিশ শতকে বটতলার অবদান কেবলমাত্র প্রকাশনা ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, হয়ে উঠেছিল বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতীক। বটতলা থেকে বহু বিষয়ের বহুরকম বই প্রকাশিত হত। এখনও কলেজ স্ট্রিট পাড়ার প্রকাশকেরাও অত বিষয়ে বই ছাপেন না। সেইসব বইয়ের মধ্যে থেকেই উঁকি মারত পঞ্জিকা। যদিও বাংলা পঞ্জিকা বটতলার আগে থেকেই হাতে হাতে ফিরছিল, তবে সেইসব পঞ্জিকা ছিল হাতেলেখা। বিভিন্ন এলাকার ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা হাতে লেখা পঞ্জিকা তৈরি করে তা প্রচার করতেন। কিছু কিছু বিক্রিও হত। বহুরকম পঞ্জিকা ছিল সেইসময়– ফুল পঞ্জিকা, হাফ পঞ্জিকা, ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা, খ্রিস্টান পঞ্জিকা, বৃহৎ মোহম্মদীয় পঞ্জিকা ইত্যাদি। সেকালে অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও পঞ্জিকা ছাপত৷ তারা তাদের বিক্রিত সামগ্রীর সঙ্গে একটি করে পঞ্জিকা উপহার দিত। তবে বটতলা প্রকাশকদের সৌজন্যেই বাংলা পঞ্জিকার রমরমা শুরু হয়েছিল। কেবল রমরমা নয়, বটতলা প্রকাশকেরা বাংলা পঞ্জিকাকে একটি প্রতিনিধিত্বকারী রূপও দিয়েছিলেন।

বটতলা থেকে যে নানা ধরনের পঞ্জিকা প্রকাশ হত তার কাটতি ছিল গোটা বাংলাদেশ জুড়ে। সেই সময় বটতলার সঙ্গেই একাত্ম হয়ে গিয়েছিল এই গোলাপী রঙের মলাটে মোরা বইটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পঞ্জিকার যে বিবর্তন ঘটতে লাগলো এবং একটি চরিত্র পাঠকের মনে যে গেঁথে গেল সেও বটতলার কারণে। বটতলার প্রকাশকেরা যে বইতে বিজ্ঞাপন ছিল তাতে বিজ্ঞাপন যুক্ত করলো, ছবিও জোগ হল তার সঙ্গে পাঠকের দৈনন্দিন প্রয়োজনে লাগবে এমন তথ্য বাড়তে থাকলো। ফলে পঞ্জিকার বহরও গেল বেড়ে। অন্যদিকে প্রকাশকের ঘরে লাভের অঙ্কও ক্রমে বাড়তে থাকলো। আসলে বটতলার পঞ্জিকা একটি মৌলিক চেহারা পেয়েছিল একদিকে পাঠকের চাহিদা অন্য দিকে বিজ্ঞাপন- তার মাঝে কাঠ খোদাইকারদের রমরমা ইত্যাদি মিলিয়ে। পঞ্জিকার জন্য ছবি, বিজ্ঞাপনের জন্য ছবি এবং নানা ধরনের কাঠ খোদাই অক্ষর। বিজ্ঞাপনেও জে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য দায় ছিল তাও না, যে যেমনভাবে পেরেছে ক্রেতার মন ভোলাবার চেষ্টা করেছে সেখানে পঞ্জিকার কোনো দায় থাকতে পারে না। সেইসব বিজ্ঞাপনে কী থাকতো বলার চেয়ে কী থাকতো না বলা সহজ। নারী পুরুষের গুপ্ত রোগের ওষুধ থেকে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার যন্ত্র। বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি বটতলা সে কালের পঞ্জিকায় যেসব ছবি ছাপতো সেগুলি ছিল যেমন মজার তেমনি কৌতূহলোদ্দীপক। বটতলার কাঠখোদাই শিল্পীদের কাজের বড় একটা বট অংশ মূলত পঞ্জিকা থেকেই উদ্ধার হয়েছে।

সে কালের পঞ্জিকায় মুদ্রিত হওয়া বিজ্ঞাপনগুলি যে সেই সময়েরবাংলা তথা বাঙালির সামাজিক ইতিহাস রচনার জরুরি উপাদান একথা বলা জায়। যতদূর জানা যায়, প্রথম বিজ্ঞাপনসংবলিত পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে। পঞ্জিকায় তখন কবিরাজি-ভেষজ ঔষধপত্রের বিজ্ঞাপন বেশি দেখা যেত। যেমন, ‘বাতবিজয়ী তৈল: সর্ব্বপ্রকার বাতনাশক পরীক্ষিত অব্যর্থ তৈল’, ‘সুবাসিত দন্তরক্ষকচূর্ণ: দন্ত শক্ত রাখিবার অব্যর্থ মহৌষধ’, ‘নেত্রসখা: চক্ষুরোগের মহৌষধ’ ইত্যাদি। কখনও কখনও রূপচর্চায় ব্যবহৃত সামগ্রীর চটকদার বিজ্ঞাপনও লক্ষ্য করা যেত। পরবর্তীতে ‘ললনা সোহাগ কেশ তৈল’, ‘পাউডার ডি জেসমিন’ বা ‘লোমনাশক চূর্ণ’। দেখা যায় গয়না, হাতঘড়ি, অস্ত্রশস্ত্র এমনকি ‘পকেট ফ্যান’-এর বিজ্ঞাপনও, জে বিজ্ঞাপনে বলা হত, ‘জার্ম্মান হইতে নূতন পকেটফ্যান আমদানি করিয়াছি। এই দারুণ গ্রীষ্মে বৈঠকখানা ও শুভবিবাহে ১টী পকেটফ্যান রাখিলে অন্য কোন পাখার আবশ্যক হয় না। মূল্য দুই টাকা, মাশুল ছয় আনা।’সেকালের পঞ্জিকায় শাকসবজি, বই কিংবা খেলাধুলার সামগ্রীর বিজ্ঞাপনও লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখ্য, সেকালের দুটি ওষুধ-প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোং’ এবং ‘ডি গুপ্ত অ্যান্ড কোং’ নিজেদের পণ্যের প্রচারের জন্য পেশাদার প্রকাশকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের পঞ্জিকা ছাপানো শুরু করেছিল। এর থেকে বোঝা যায়, তখন পঞ্জিকা বিজ্ঞাপনের কারণেও সাধারণ মানুষের কাছে কতটা আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।

সেকালের পঞ্জিকায় এতরকম বিজ্ঞাপন থাকত যে পঞ্জিকার পাতার বিজ্ঞাপন দেখেই অনেক কিছু জানা হয়ে যেত। তাছাড়া কাঠখোদাই, ধাতুখোদাই করা নানারকম ছবি তো থাকতোই যেমন, হালখাতা, ভাইফোঁটা, চড়কপুজো, শিবপুজো, দোলযাত্রা-সহ বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি সেগুলিও ছিল খুবই আকর্ষক! বইয়ের বিজ্ঞাপনের লেখাগুলিও ছিল পাঠের মতো। যেমন, দুই হাজার মুষ্টিযোগ শিক্ষা, গৃহস্থের কবিরাজী শিক্ষা, বৃহৎ রতিশাস্ত্র, অদ্ভুত বশীকরণ মন্ত্র শিক্ষা ইত্যাদি লেখাগুলি পড়ে পাঠক বইটি কিনতে বাধ্য হত। গোয়েন্দা বইগুলির বিজ্ঞাপনের কপি ছিল অসাধারণ। যেমন, সেকালের জনপ্রিয় গোয়েন্দা লেখক ছিলেন পাঁচকড়ি দে। তাঁর ‘নীলবসনা সুন্দরী’ বইয়ের বিজ্ঞাপনের কপি লেখা হয়েছিল, ‘… পাঁচকড়ি বাবুর অসাধারণ ক্ষমতা, সে পরিচয় সকলে অবগত আছেন। তিনি দুর্ভেদ্য রহস্যাবরণের মধ্যে হত্যাকারীকে এরূপভাবে প্রচ্ছন্ন করিয়া রাখেন যে, পাঠক যতই নিপুণ হউন না কেন, যতক্ষণ গ্রন্থকার নিজের সুযোগমত সময়ে, স্বয়ং ইচ্ছাপূর্ব্বক অঙ্গুলি নির্দেশে হত্যাকারীকে না দেখাইয়া দিতেছেন, তৎপূর্ব্বে কেহ কিছুতেই প্রকৃত হত্যাকারীর স্কন্ধে হত্যাপরাধটা চাপাইতে পারিবেন না– অমূলক সন্দেহের বশে পরিচ্ছেদের পর পরিচ্ছেদে কেবল বিভিন্ন পথে চালিত হইবেন।…’

তবে বটতলার পঞ্জিকার চরিত্র অনেকদিন আগেই হারিয়ে গিয়েছে।এখন অনেকটাই শহুরে ধোপদুরস্ত এবং তা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েই তবু বলতে দ্বিধা নেই যে বটতলার পঞ্জিকার এলোমেলো চরিত্রটাই ছিল তার নিজস্ব। তবু সেকাল থেকে একালেও বাংলা বইয়ের দুনিয়ায় বেস্টসেলার পঞ্জিকা৷