বিচিত্র প্রাণী জগতের এক বিস্ময় হল অক্টোপাস। এটি পৃথিবীর অন্যতম বুদ্ধিমান প্রাণী। মানুষের মস্তিষ্কে ১০ হাজার কোটি নিউরন বা স্নায়ুকোষ থাকে। আর অক্টোপাসের মাথা ও শরীর জুড়ে থাকে ৫০ কোটি নিউরন। এই জন্য অক্টোপাস নিজেই পরিকল্পনা করতে পারে ও কিছুটা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে পারে। গবেষকেরা দেখেছেন, ইন্দোনেশিয়ার অক্টোপাসগুলি ঝোড়ো আবহাওয়ার প্রস্তুতির জন্য আধভাঙা নারকেলের খোল সংগ্রহ করে। ঝড় শুরু হলে খোলের ভেতরে ঢুকে দরজার মতো করে দুটো টুকরোকে জুড়ে দেয়। অক্টোপাস সম্পর্কে মিলার্সভিল ইউনিভার্সিটির আচরণ বিষয়ক গবেষক জিন বোয়াল বলেন, অক্টোপাস একটি বুদ্ধিমান প্রাণী এবং এরা মানুষ এবং অন্য অক্টোপাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। গবেষণাগারে বোয়াল একটি অক্টোপাসকে বাসি স্কুইড খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু অক্টোপাসটি চোখের ইশারায় বোয়ালকে বুঝিয়ে দেন, এই স্কুইড সে খাবে না! পাশের একটি ড্রেনে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অক্টোপাসটি বাহু দিয়ে ইশারা করে।সাধারণত প্রাণীদের দুটো হার্ট ও একটি ব্রেন বা মস্তিস্ক থাকে! কিন্তু অক্টোপাসের নটি মস্তিস্ক বা ব্রেন ও তিনটি হ্রদপিন্ড বা হার্ট রয়েছে!

অক্টোপাসের সেন্ট্রাল ব্রেন নার্ভাস সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে। পাশাপাশি অক্টোপাসের ৮টা হাতে রয়েছে একটি করে ছোট ব্রেন বা মস্তিস্ক। গবেষকরা বলেন, এই ছোট ব্রেন হল কিছু নার্ভ সেল যা অক্টোপাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করে। একদিকে যেমন ৮টা হাতকে স্বাধীনভাবে নড়াচড়া করতে দেয়, অন্যদিকে অক্টোপাসের ৮ টা হাত যাতে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে, তাও নিয়ন্ত্রণ করে। অক্টোপাসের শরীরে রয়েছে দুটো ছোট প্লেট যা দু-পাশ থেকে মাথাকে ধরে রেখেছে, রয়েছে একটি ঠোঁট যা শিকার ধরতে সাহায্য করে। শরীরের বাকি অংশ পেশী দিয়ে গঠিত। দুটো হার্ট শুধুমাত্র রক্ত পাম্প করে। আরেকটি বড় হার্ট বাকি শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে। অক্টোপাস শত্রুর চোখে ধুলো দিতে ওস্তাদ। আট পা ছাড়াও এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এদের রক্তের রং নীল। নীল হওয়ার কারণ হিমোসায়ানিন নামে একটি রঞ্জক পদার্থ। এই রঞ্জক পদার্থ অক্টোপাসের শরীরে অক্সিজেন বহন করে। হিমোসায়ানিন অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়। এতে তামার পরমাণুগুলি অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে Cu²⁺ (কপার আয়ন) তৈরি করে। এই বিক্রিয়ার ফলে হিমোসায়ানিন নীল রং ধারণ করে। অনেকটা আমাদের রক্তে থাকা হিমোগ্লোবিনের মতো, যা লোহা ও অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে লাল রং ধারণ করে। এখানে মূল পার্থক্য হলো, হিমোসায়ানিন তামা ব্যবহার করে, আর হিমোগ্লোবিন ব্যবহার করে লোহা। ঠান্ডা জল ও কম অক্সিজেনযুক্ত পরিবেশে হিমোসায়ানিন হিমোগ্লোবিনের চেয়ে বেশি কার্যকর। অক্টোপাসের রক্তে হিমোসায়ানিনের পরিবর্তে হিমোগ্লোবিন থাকলে কী হতো? কেন ওদের রক্তে হিমোগ্লোবিন নেই? এতে অবশ্য একটা সমস্যা হতো। অক্টোপাসকে সমুদ্রের ওপরিভাগে তেমন ভেসে বেড়াতে দেখা যায় না। আট পায়ের সাহায্যে এরা সমুদ্রের সমুদ্রের গভীরে বিচরণ করে। গভীর সমুদ্রের ঠান্ডা পরিবেশে অক্সিজেনের ঘনত্ব থাকে কম। এমন পরিবেশে হিমোগ্লোবিনের চেয়ে হিমোসায়ানিনই ভালোভাবে অক্সিজেন পরিবহন করতে পারে। ঠান্ডা জল ও কম অক্সিজেনযুক্ত পরিবেশে হিমোসায়ানিন হিমোগ্লোবিনের চেয়ে বেশি কার্যকর। গবেষকরা দেখেছেন, অ্যান্টার্কটিকার অক্টোপাস প্যারালেডন চার কোটি প্রজাতির অক্টোপাসের রক্তে অন্যান্য উষ্ণ অঞ্চলের অক্টোপাসের তুলনায় বেশি হিমোসায়ানিন থাকে। ফলে এটি অ্যান্টার্কটিকার প্রচণ্ড ঠান্ডা জল এমনকি তাপমাত্রা মাইনাস ১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও টিকে থাকতে পারে। হিমোসায়ানিনের জন্যই অক্টোপাসের রক্তের রঙ নীল হয়।

শিকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য অক্টোপাস শিকারের দিকে এক ধরনের কালি ছুড়ে দেয়। ছুড়ে দেওয়া কালি শুধু তাকে শিকারের হাত থেকে লুকোতেই সাহায্য করে না, এটা শত্রুকে শারীরিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন করে। এই কালিতে টাইরোসিনেজ নামক একপ্রকার পদার্থ থাকে। মানুষের মধ্যে টাইরোসিনেজ প্রাকৃতিক রঞ্জক মেলালিন তৈরিতে সাহায্য করে। অক্টোপাস এই টাইরোসিনেজ তার শত্রুর দিকে ছুড়ে মারলে, শত্রু কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। এই কালির আরেকটি গুণ হচ্ছে এটি শত্রুর ঘ্রাণশক্তি এবং স্বাদ অনুভবের ক্ষমতা কিছুক্ষণের জন্য নষ্ট করে দেয়। মুহূর্তে শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে নিজেকে শত্রুর সামনেই ছদ্মবেশে লুকিয়ে ফেলার অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে অক্টোপাসের।প্রাণিজগতে ছদ্মবেশ ধারণে অক্টোপাসের জুড়ি নেই। সেকেন্ডের দশ ভাগের তিন ভাগ সময়ে নিজের শরীরের রঙ পরিবর্তন করতে সক্ষম। বিপদের সম্মুখীন হলে বা শিকার ধরার প্রয়োজনে সমুদ্রের তলদেশের বিভিন্ন শৈবাল কিংবা পাথরের মতো করে নিজেকে উপস্থাপন করতে ওস্তাদ।

জলের ভেতর তৈরি হওয়া বিভিন্ন গোলকধাঁধাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা সহজেই সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে। রসিকতায়ও কম যায় না এরা। অনেক সময় তারা দুষ্টুমির ছলে জেলেদের নৌকা আটকে দেয়। নারকেল খোসা, ঝিনুক-শামুকের খোলসে বাসা বাধা সহ তারা কাঁকড়ার খোলস ছাড়ানোর পর তাদের মাংস খেয়ে উদরপূর্তি করতে পারে। জার খোলার ব্যবস্থাও এদের জানা আছে। বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকলে আমরা যেমন দাঁত দিয়ে নখ কাটি, অক্টোপাসও এমন অবস্থায় নিজেদের উপাঙ্গ কামড়ে খেয়ে বিষণ্ণতা কাটানোর চেষ্টা করে। অক্টোপাসের স্নায়ুতন্ত্র মানুষের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের। মস্তিষ্কের আকারও বেশ বড়। অথচ তাদের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে চিনতে পারা সহ অনেক বিস্ময়কর দক্ষতা রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা প্রমাণও পেয়েছেন। অক্টোপাসের শরীরে কোনো হাড়ের অস্তিত্ব নেই। তাই তাদের বাহুগুলো যেকোনো আঘাতে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। তবে এ নিয়ে অক্টোপাসকে খুব বেশি মাথা ঘামাতে হয় না। কারণ, অক্টোপাসের পুনরুৎপাদন ক্ষমতা বেশ ভালো। এই ক্ষমতায় তার কোনো বাহু বা বাহুর অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, দ্রুত তা পুনরুৎপাদন হওয়া শুরু করে। এক্ষেত্রে নিডারিয়া পর্বের হাইড্রার সাথে অক্টোপাসের বিশেষ মিল লক্ষ্য করা যায়।

সাগরের প্রাচীন এই প্রাণী নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই অবাক বনে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। শুধু বুদ্ধি কিংবা চাল চলনই নয়, প্রাণীটির মস্তিষ্ক আর জিন পরীক্ষা করেও গবেষকদের বিস্মিত হতে হয়েছে। মানুষের চাইতেও অক্টোপাসের জিনের সংখ্যা ১০ হাজার বেশি। এই জিনের বৈচিত্র্যের কারণেই হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে সাগরের রহস্যপূর্ণ এই প্রাণীটি।
