জেলে বন্দি থাকাকালীনও নেতাজী দুর্গাপুজো করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের তীব্র বাধার সত্বেও ১৯২৫ সালে বার্মায় মান্দালয়ের জেলে এবং ১৯৪০ সালে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি জেলে সরকারের সব রকম অসহযোগিতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মহাসমারোহে সুভাষ দুর্গাপুজোর ব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তখন জেলে ছিলেন যারা তারা প্রায় প্রত্যেকেই তাতে অংশগ্রহণ করেন। নেতাজীর অকাট্য যুক্তির কাছে হার স্বীকার করেছিল জেল কতৃপক্ষ। নেতাজী চিঠিতে লেখেন, জেলে মুসলিম কয়েদিদের জন্য ঈদের সময় এবং বড়দিনে খ্রিস্টানদের জন্য যেমন সুযোগ সুবিধা এবং ভাতা দেওয়া হয়, তেমনি হিন্দুদেরও, বিশেষত বাঙালিদের এই সর্ববৃহৎ উৎসবে যোগদান করতে বাধা দেওয়ার কোনো কারণ থাকা উচিত নয়। ইংরেজদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির বিরুদ্ধে এই সিংহ গর্জন থামানোর ক্ষমতা আর কারও ছিলনা। প্রথা অনুযায়ী

রীতিমতো পুরোহিত দিয়ে চার দিন ধরে ধূমধাম করে জেলেই দূর্গা পুজো করেন নেতাজী। খরচ-খরচা নিয়ে নানান অসুবিধা সত্বেও এই কাজ তিনি সম্পন্ন করেছিলেন। কারণ এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সব বন্দীদের সঙ্গে গোপন পরামর্শ করার সুবর্ণ সুযোগ। আর এতসব আয়োজন বা সমাহারের মধ্যে থেকেও দেশব্রতের আদর্শ থেকে তিনি যে ন্যূনতম বিচ্যুত হননি তার প্রমাণ প্রেসিডেন্সী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দু’মাসের মধ্যেই তিনি দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য মহা নিষ্ক্রমণের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন। যাবার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন, “দেশমাতৃকা জননী জন্মভূমির সেবা করতে হলে দিতে হবে মান, সম্মান, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, গৌরব, ইন্দ্রিয়ের সব বৃত্তি, ভাবনা এবং সবশেষে আত্মাকে। এই না হলে মাতৃ সাধনা হবে না।”

মান্দালয় থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সুভাষচন্দ্র স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে যান শিলঙে। সেখান থেকে ১৯২৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তীদেবীকে একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, “মানুষের জীবনে এমন একটি স্থান চাই যেখানে বিতর্ক থাকবেনা, বিচার থাকবে না, বুদ্ধি বিবেচনা থাকবে না, থাকবে শুধু ব্লাইন্ড ওয়ারশীপ। তাই বুঝি মায়ের সৃষ্টি। ভগবান করুন যেন আমি চিরকাল এই ভাব নিয়ে মাতৃ পূজা করে যেতে পারি।” দেশের প্রতি, মাতৃ জাতির প্রতি কী প্রচণ্ড আবেগ নেতাজীর হৃদয়ে ছিল তার প্রমাণ এই লেখা। আসলে দেশের মুক্তি সংগ্রামে বাংলার যুব শক্তিকে উদ্দীপিত করার জন্য নেতাজি দেবী দুর্গার আরাধনাকেই বেছে নিয়েছিলেন। দেশ ও জগৎজননীর আরাধনাকে পরিণত করতে চেয়েছিলেন প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ শক্তির বিরোধিতার অস্ত্র হিসেবে। লোকমান্য তিলকের শিবাজী উৎসবের মতো তিনিও বাঙালির সর্ববৃহৎ উৎসবকে এক সার্বজনীন রূপ দিতে চেয়েছিলেন। উত্তর কলকাতার তিন তিনটি বারোয়ারি দুর্গা পুজোর প্রচলন-এর সঙ্গেও নেতাজির নাম জড়িয়ে আছে। সিমলা, বাগবাজার আর কুমোরটুলি। আজও এই পুজোগুলির জনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত।

১৯১৯ সালে নেবু বাগান বারোয়ারী উৎসব ছিল কলকাতার প্রথম সার্বজনীন দুর্গাপুজো। কারণ এর আগে দূর্গাপুজোয় ছিল কেবলমাত্র বাবু ও জমিদার শ্রেণীর অধিকার। এর বিরোধিতায় চালু হয় ওই পুজো যা পরবর্তীতে পরিচিত হয় বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব রূপে। ১৯৩৮-৩৯ সালে এই পুজোর সভাপতিত্ব করেন নেতাজী। অতসী বর্ণ দূর্গা ও সবুজ বর্ণ অসুরের মূর্তি এই পুজোর মূল আকর্ষণ। এর ফলে জনসাধারণের জন্য খুলে যায় মাতৃ আরাধনার দ্বার। কুমোরটুলির দূর্গাপুজোর একটি অসাধারণ ঐতিহাসিক কাহিনী আছে। সুভাষচন্দ্র বসুর নাম যার সঙ্গে ওতোপ্রতোতভাবে জড়িত। ১৯৩১ সালে হরিশংকর পালের সভাপতিত্বে এই পুজো শুরু হলেও ১৯৩৭-৩৮ সালে কুমোরটুলি দূর্গা পূজা কমিটির সভাপতি হন সুভাষচন্দ্র। কিন্তু সেবার পঞ্চমীর দিন আগুন লেগে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পূজোর উদ্যোগ। পুড়ে যায় দুর্গা মূর্তি। এই ঘোর বিপত্তিতেও নেতাজী কিন্তু দমে যাননি। তাঁর একান্ত অনুরোধে বিখ্যাত শিল্পী গোপেশ্বর পাল দুর্গামূর্তি তৈরি করতে রাজি হলেন। কিন্তু রাতারাতি সেই মূর্তি স্থাপনের জন্য তিনি এক অভিনব পন্থা উদ্ভাবন করলেন। একচালার পরিবর্তে আলাদা আলাদা করে নির্মিত হল লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ আর দুর্গামূর্তী অর্থাৎ একচালার বদলে পাঁচ চালা দূর্গা প্রতিমা নির্মাণ করে ইতিহাস রচনা করলো কুমোরটুলি সার্বজনীন। পুরোহিতরা অবশ্য শুরুতেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ওই একজনের নামই তাদের সব বিরোধিতা মিটিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

১৯২৬ সালের শুরু হয় সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজো। হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি হয় পূজোর প্যান্ডেল। কিন্তু পুজো ছিল নিমিত্ত মাত্র। তার আড়ালে একত্রিত হতেন বিপ্লবীরা। স্থির হত তাদের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপ। লাঠি–ছুড়ি–বল্লম-এর নানান খেলা ও কসরত দেখানোর ব্যবস্থা করা হত। পালিত হত বীরাষ্টমী ব্রত। দূর দূরান্ত থেকে বহু লোক আসতো সেসব দেখতে। আক্ষরিক অর্থে এই ছিল সার্বজনীনতা। ১৯৩২ সালে বিপদের গন্ধ পেয়ে এই পুজো বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু ১৯৩৪ সালে নেতাজীর সভাপতিত্বে আবার শুরু হয় সিমলা ব্যায়াম সমিতির দুর্গোৎসব।তাই এই সার্বজনীন দূর্গাপুজো যা এখন বাঙালিকে হেরিটেজ তকমা এনে দিয়েছে তার পিছনে আমাদের দেশনায়কের ভূমিকা বিস্মৃত হলে চলবে না। এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র।
