আমরা সবাই জানি যে, গ্রহের আঘাতেই ডাইনোসরের মতো দানব পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। হিসেব অনুযায়ী আজ থেকে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে ৬ মাইল চওড়া এক গ্রহ ম্যাক্সিকোর উপকূলে আঘাত হেনেছিল। যে আঘাতে মুহূর্তের মধ্যে ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি আর সুনামি ফুঁসে উঠেছিল। আর সেই সব ঘটনাতেই গোটা ডাইনোসর প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যুর সংখ্যা হিসেব করা তো অসম্ভব। বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ‘পিনাস’-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে থেকে আমরা জানতে পারি বিজ্ঞানীরা সেই গ্রহের আঘাতের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করেন কম্পিউটারের মাধ্যমে। সেই সময়ের জলবায়ুর পরিবর্তন দেখেছেন তারা। এক দুঃস্বপ্নের মতো ফলাফল বেরিয়ে এসেছে।

ডাইনোসর প্রজাতির পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া, অন্যান্য বহু প্রাণীর মৃত্যু ছাড়াও গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবীর মতো গ্রহও একটানা দু’বছরের মতো অন্ধকারে নিজজ্জিত ছিল। এক বিবৃতিতে গবেষক ওয়েন টুন বলেন, ওই ঘটনায় পৃথিবীর পাথর রীতিমতো বাষ্পীভূত হয়ে যায়। সেই পাথর এক সময় আকাশ থেকে বৃষ্টি মতো ঝরতে থাকে। এই দুনিয়ার বায়ুমণ্ডলে ১৫ শো কোটি বার রীতিমতো পাথরের গুলিবর্ষণ ঘটতে থাকে। তখন সূর্যটা ঢেকে গিয়েছিল। অমাবশ্যার রাতের মতো হয়েছিল দিন। সেই ঘটনায় উদ্ভিদের ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ১৮ মাসের জন্যে। অন্ধকার সেই পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ প্রাণ ধ্বংস হয়ে যায়। যারা প্রাণ বাঁচাতে তাৎক্ষণিকভাবে গভীর সাগরে বা মাটির নীচে পালাতে পারতো তারাও সুযোগ পায়নি। এদিকে, আলোর অভাবে সাইটোপ্লাঙ্কটনের মৃত্যু ঘটে। এটাই সাগরের খাদ্যচক্রের মূল উপাদান। সেই সঙ্গে গ্লোবালি স্থলভাগের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াম কমে যায়। সিকার জানায়, পৃথিবীর তাপমাত্রা স্বাভাবিক হতে ৭ বছর সময় নেয়। এতে ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে অতিবেগুনী রশ্মি আটকানোর ক্ষমতা কমে যায়।

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অন্ধকার ঘটনা আরও ঘটেছে। ৫৩৬ সালে টানা আঠারো মাস ধরে বিশ্বের বিরাট একটি অঞ্চলে আকাশ ছিল অন্ধকার। রহস্যময় এক কুয়াশা ঢেকে রেখেছিল সূর্যকে। এর ফলে চারদিক হয়ে পড়ে অন্ধকার। দীর্ঘ ১৮ মাস সূর্যের দেখা পায়নি বিশ্ববাসী। আমেরিকার হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগ বিষয়ে ইতিহাসবিদ এবং নৃতত্ত্ববিদ মি. ম্যাকরমিক বলছেন ওই বছর একটা রহস্যজনক কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছিল ইউরোপ, মধ্য প্রাচ্য ও এশিয়ার অনেক জায়গার আকাশ। যেসব দেশের আকাশে এই কুয়াশা নেমে এসেছিল সেসব দেশে ১৮ মাস একনাগাড়ে সূর্যের আলো দেখা যায়নি। সূর্যকে আঠারো মাস ধরে ঢেকে রেখেছিল ওই কুয়াশার চাদর। একজন ইতিহাসবিদ লিখেছেন ওই ১৮ মাস সূর্যের আলো ছিল চাঁদের আলোর মত স্তিমিত ও ঠাণ্ডা। মাইকেল ম্যাকরমিক বলছেন, সেটা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুঃস্বপ্নের সময় যে সময় পৃথিবীর ওই দেশগুলো আর কখনও পার করেনি। পৃথিবীর একটা বিস্তীর্ণ এলাকার আকাশ গ্রাস করেছিল ওই রহস্যজনক কুয়াশা। দীর্ঘ অতগুলো মাস সূর্য তাপ ছড়াতে না পারায় তাপমাত্রা নেমে যায়। ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে মানুষের বেঁচে থাকা দুষ্কর হয়ে ওঠে ওই সময়কালে।

বিগত ২৩০০ বছরের মধ্যে সেই সময়টাই ছিল সবচেয়ে শীতল যুগ। এই শীতলতম যুগ ও রহস্যময় কুয়াশার কথা ইতিহাসবিদরা অনেক দিন থেকেই জানতেন। কিন্তু এর সঠিক কারণ জানা ছিল না। গবেষকদের ধারণা আগ্নেয়গিরির ওই উদ্গীরণ থেকে সৃষ্ট কুয়াশা বাতাসের সাথে ছড়িয়ে গিয়েছিল ইউরোপে এবং পরে মধ্য প্রাচ্য ও এশিয়ার অনেকগুলো দেশে। এর থেকেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আবহাওয়া ও শীতল যুগের বিপর্যয় নেমে এসেছিল দেশগুলোর ওপর। বর্তমানে গবেষকরা সেই কুয়াশার রহস্য ভেদ করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই রহস্যময় কুয়াশার কারণ হিসেবে জানিয়েছেন, ৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকের আইসল্যান্ডে আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের ঘটনা। তখন উত্তর গোলার্ধে ছাই ছড়িয়ে পড়ে এবং কুয়াশা তৈরি হয়। ১৮ মাস সূর্য না ওঠার বিষয়টি নিয়ে বাইজানটাইন ঐতিহাসিক প্রোকোপিয়াস লিখেছিলেন, দীর্ঘ ১৮ মাস সূর্যের আলো চাঁদের মতো হয়ে ছিল। অন্ধকার যেন কাটছিলোই না। মাঠভরা ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মানুষ ঠান্ডায় ঘর থেকে বের হতেও পারছিল না। চারদিকে শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। না খেয়ে ঘরে ঘরে মানুষ মরে যাচ্ছিল। কারো আর্তনাদ শোনার মতো কেউ ছিল না।

১৯৯০ এর আগে ‘অন্ধকার যুগ’ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। বেশকিছু গবেষণা হোয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক এবং এন্টিওকিটি পেপারের সহ-লেখক মাইকেল ম্যাককর্মিক বলেন, ১৮৫৩ সালে যে আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল, তারপর গবেষকরা আয়ারল্যান্ডের গাছগুলো পরীক্ষা করেন। তারা সর্বত্রই আগ্নেগিরির ছাই দেখতে পান। তাদের ধারণা ৫৩৬ সালেও একই ঘটনার জেরে বিশ্ববাসী সূর্যের দেখা পায়নি। এতা সত্যি যে একটি দুর্দান্ত পরিবর্তন ছিল জলবায়ুর। আর বিষয়টি এক রাতের মধ্যেই ঘটেছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ বছর ৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দ। কারণ তখন বেঁচে থাকা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিজ্ঞানীরা এও বলেন, এখন পর্যন্ত আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটনার রহস্য অজানা। ৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দের কুয়াশার কারণ হিসেবে তারা আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের ছাইকেই দোষারোপ করেন। ভয়ংকর ওই আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের ফলেই সূর্য ছাইয়ে ঢেকে যায়। এর ঠিক কয়েক বছর পরেই ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে বুবোনিক প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে। রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে মিশর-ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে মহামারি প্লেগ। অন্ধকার যুগ এবং প্লেগের ভয়াবহতার কারণে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ মারা যায় ৫৩৬ থেকে শুরু করে ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দ সময়কাল পর্যন্ত।
