আচমকা অনশনরত জুনিয়র ডাক্তার এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে কতিপয়জন একটু বেশি রকম উৎসাহী হয়ে পড়েছেন। কেবল তাই নয়, তাঁদের উৎসাহের মাত্রা এতটাই প্রবল আকার ধারণ করেছে যে তারা রবিবার আর জি কর ইস্যুতে বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে চেয়ে রাজ্য সরকার ও আন্দোলনরত চিকিৎসকদের চিঠি দিয়েছেন। দুপক্ষকে ইমেল করে তাঁদের আবেদন, যে অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান ঘটিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা স্বাভাবিক রাখতে অবিলম্বে আলোচনার টেবিলে বসা হোক। পাশাপাশি জুনিয়র ডাক্তারদের স্বাস্থ্যের যেভাবে অবনতি হচ্ছে, সেই প্রেক্ষিতে জুনিয়ার ডাক্তারদের অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধও করেছেন তাঁরা। এরা আমাদের সমাজে বিশিষ্টজন বলে পরিচিত, এদের মধ্যে কেউ সিনেমা পরিচালক, অভিনেতা ইত্যাদি প্রভৃতি। কিন্তু দুর্ভাভ্যের বিষয় বিশিষ্টজনদের, ওই প্রস্তাব কার্যত ফিরিয়ে দিয়েছেন আন্দোলনকারী জুনিয়ার ডাক্তারেরা। রবিবার রাতেই ধর্মতলার অনশনমঞ্চ থেকেই অনশনকারী ডাক্তারদের পক্ষ থেকে ডাক্তার দেবাশিস হালদার স্পষ্ট ভাষাতেই জানিয়েছেন, “মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই”।

সমাজের বিশিষ্টজনেদের এই প্রবল উৎসাহের কারণে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তারা নিজেদের বিশিষ্ট বা উৎকৃষ্ট যাই ভেবে থাকুন, মধ্যস্থতা করাটা কি তাদের কাজ বা তাদের কাজের মধ্যে পড়ে? তারা জুনিয়ার ডাক্তারদের ১০ দফা দাবি ভিত্তিক আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারেন, যদি আন্দোলনকে তারা যুক্তিযুক্ত মনে করেন তাহলে পাশে থাকতে পারেন, কিন্তু সরকারের সঙ্গে জুনিয়ার ডাক্তারদের মধ্যস্থতা করাবার দায়িত্ব সমর্পণ করলো কে বা কারা। আন্দোলন করছেন জুনিয়ার ডাক্তারেরা, সেই আন্দোলন ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত বলেই সহনাগরিকেরা তাঁদের পাশে রয়েছেন, সিনিয়ার ডাক্তারেরাও সঙ্গে রয়েছেন। মধ্যস্থতা করতে চাওয়ারা যদি নিজেদের নাগরিক মনে করেন, তাহলে তাদের জানা উচিত যে মধ্যস্থতা নাগরিকদের কাজ নয়। তাছাড়া মধ্যস্থতা এক ধরনের দালালি। অন্যদিক থেকে মধ্যস্থতা আইনি সমস্যা সমাধানের একটি উপায়ও বটে। এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে যার কোনোটি প্রযোজ্য নয়। এছাড়া মধ্যস্থতা একটি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া।

প্রসঙ্গত, স্যাকভান বারকোভিচ মধ্যস্থতাকে বলেছেন, সংঘাত ব্যবস্থাপনার একটি প্রক্রিয়া, যেটি পক্ষের আলোচনার সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু আলাদা, যেখানে দ্বন্দ্বে থাকা মানুষেরা একজন বহিরাগতের সহায়তা চান বা তার কাছ থেকে সাহায্যের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। অন্যদিকে ব্ল্যাক’স ল ডিকশনারির সংজ্ঞা অনুসারে, মধ্যস্থতা হল, একটি নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষকে যুক্ত করা, যে বা যারা বিবাদমান পক্ষদুটিকে একটি পারস্পরিক সম্মত সমাধানে পৌঁছাতে সাহায্য করতে চেষ্টা করবে। আদালতে মামলা দায়ের করার পরেও সাধারণ মধ্যস্থতা হয়। অনেক সময় আদালতে মামলা শুরু হওয়ার আগেও হয়। মধ্যস্থতায় যাওয়ার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো আইনজীবীর প্রয়োজন হয়না। তাই ফের প্রশ্ন, বিশিষ্টজনেরা জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলনে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিবাদ, আইনি সমস্যা কোনটিকে খুঁজে পেলেন যে তারা মধ্যস্থতা করতে চাইছেন? চাইলেও সেই যোগ্যতা কি তাদের আছে? স্পষ্ট ভাষাতেই বলা যায় না, নেই। কারণ, তারা এই আন্দোলনের চরিত্র-প্রকৃতি-দাবী সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল নন, সেগুলি জানা-বোঝার দায়ও তাদের নেই, এই আন্দোলন যে সমাজের একটি ব্যবস্থা বদলের দাবী সেকথা তারা বুঝতে অক্ষম।

তাই রবিবার রাতেই ধর্মতলার মঞ্চ থেকে ডাক্তার দেবাশিস হালদারের জবাব, বিশিষ্টজনরা তাঁদের পাশে রয়েছেন, সেটা তাঁদের খুবই ভালো লেগেছে। কিন্তু তাঁরা যে প্রস্তাব রেখেছেন, তাঁদের আর সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতা করার সেটা মোটেও ভালো লাগার নয়। অনশনকারীদের অনেকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে, সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, অনশন যেন তাঁরা তুলে নেয়। এসব কী বলছেন তারা, যা বলছেন ভেবে চিন্তে বলছেন কী? যাঁরা দু’মাসের বেশি সময় ধরে এত বড় একটা আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ পথে এগিয়ে নিয়ে চলছেন, আটদিন ধরে অনশন করছেন, তাঁদের মনোবল কী এতই দুর্বল যে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি মানেই তাঁরা লড়াই থেকে সরে যাবেন। সরকার, শাসক দল সব ধরনের পীড়ন তাঁদের উপর চালিয়ে যাচ্ছেন, নেতা মন্ত্রীরা কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ শানাচ্ছেন, আলোচনায় ডেকে এনে ঝুড়ি ঝুড়ি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন আর তা পালন না করে বলছেন, নব্বই শতাংশ কাজ হয়ে গিয়েছে। মিথ্যা কথা বলারও যে একটা সীমা থাকে সেটা তারা জানেন না। সন্তানসম ছেলে মেয়েরা দিনের পর দিন স্রেফ কয়েক ফোঁটা জল মুখে দিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেও তো পুজো উদ্ধোধন, ঢাক বাজানো, ডান্ডিয়া নাচে আপত্তি জানাননি। কিন্তু বিশিষ্টজনেরা যখন তাঁদের আন্দোলন থেকে সরে আসতে বলেন তখন তাঁরা বলতে বাধ্য হন, “আমাদের কোনো মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন নেই। পাশে থাকুন কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য, ব্যক্তিগত রাজনৈতিক পরিচয়কে বাদ দিয়ে।”

বিশিষ্টজনেরা অনশনকারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এর জন্য তাদের আবেগকে সম্মান জানিয়েও বলতে হয়, তারা নাগরিকসমাজের সক্রিয়তার উপর ভরসা রেখেই জুনিয়ার ডাক্তারদের অনশন প্রত্যাহার করা দরকার বলছেন, একই সঙ্গে এও জানা বোঝা গেল নাগরিক সমাজ বা তাদের সক্রিয়তা সম্পর্কে তাদের কেমন মনোভাব। কিন্তু হে বিশিষ্টজনেরা, আন্দোলনকারীদের স্পিরিটটা ঠিক কোথায় সেটা কি আপনারা অনুমান করতে পারেন? না, আপনারা যে অবস্থার কথা ভাবছেন ঠিক সেই জায়গায় কিন্তু নেই। কারণ, কেউ মধ্যস্থতার কথা বলবেন আর তাঁরা অনশন থেকে উঠে যাবেন এমনটা তাঁরা নন। তাঁদের স্বাস্থ্য নিয়ে যখন এতটাই চন্তা আপনাদের তখন জুনিয়ার ডাক্তারদের ১০ দফা দাবি কেন আপনারা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়ে লিখিত উত্তর আনার চেষ্টা করলেন না। উলটে চেষ্টা করছেন জুনিয়ার ডাক্তাররা যাতে একটা সত্যিকারের আন্দোলন মাঝপথে ছেড়ে চলে যায়। এটাই কী আপনাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নাকি এটাই আপনাদের কাজ?

আপনারা প্র্যাকটিস চালিয়ে যান, পিপলস পাওয়ার অর্থাৎ জনগণের শক্তি যা যে-কোনও দলের সংগঠিত শক্তির থেকে অনেক বেশি, তা আপনারা জানা বোঝা তো দুরের কথা অনুমানও করতে পারছেন না। জানেন কী সচেতন, সংগঠিত জনশক্তিকে পুলিশ-মিলিটারি দমন করতে পারে না, বিচারব্যবস্থাও যা-খুশি রায় দিতে পারে না। বাইরে থেকে আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে, প্রতিবাদ না করে মানুষ বোধহয় সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে, আপনারা টের পাননি বাস্তবে শাসকের দুষ্কর্ম মানুষের মনে বিক্ষোভের বারুদ হয়ে জমে উঠেছে। যে কোনও একটি স্ফূলিঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটবে। সময় থাকতে মধ্যপথ বা মধ্যস্থতার রাস্তা থেকে সরে যান।