আরজি কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনার বিচার চেয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা, এখন তাঁরা ধর্মতলায় অনশন মঞ্চে। জয়নগরের কিশোরীর ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন আরও বৃহৎ আকার ও অন্য মাত্রা নিয়েছে। কারণ, ওই ইস্যু তাঁদের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। কেবল তাই নয়, এই অবস্থায় জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে সিনিয়ররাও নামছেন অনশনে। সিনিয়র চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী জানিয়েছেন, সোমবার থেকে তাঁরাও অনশন শুরু করবেন। জুনিয়রদের এতদিনের আন্দোলনকে বৃথা হতে দেবেন না। প্রায় ৫৮ দিন পর কর্মবিরতি তুলে গত শনিবার থেকে জুনিয়র ডাক্তাররা কাজে ফিরেছিলেন। কিন্তু তাঁদের দাবিদাওয়া সম্পর্কে রাজ্য সরকার উদাসীন। নিজেদের দাবি পূরণে সরকারের উপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে তাই বাধ্য হয়েই জুনিয়ার ডাক্তাররা আমরণ অনশন শুরু করেছেন। গত শনিবার অনশনে বসার আগেই তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন, অনশন করতে গিয়ে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার দায় নিতে হবে রাজ্য সরকারকে। শনিবার আর জি কর বাদ দিয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ৬ প্রতিনিধি অনশন করেন। তাঁদের এই অনশনকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছেন সিনিয়র চিকিৎসকরাও।

অন্যদফিকে শনিবারই জয়নগরের কুলতলিতে ৯ বছরের নাবালিকার ধর্ষণ-খুনের ঘটনা ঘটে। সেই খবর আর জি করের ক্ষত যেন আরও উসকে উঠেছে। সিনিয়র ডাক্তারদের ১২ জনের একটি দল রবিবার ঘটনাস্থল মহিষমারি গ্রামে যায় নির্যাতিতার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, ”এ ধরনের অপরাধ যেখানেই সংঘটিত হবে, আমরা সেখানেই যাব প্রতিবাদ করতে। কারণ, এসব ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য প্রশাসন আগে থেকেই সতর্ক হতে পারত। এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক থাকলে এমনটা ঘটে না। সেখানেই প্রশাসনের ব্যর্থতা।” এর পর জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, “ওরা অনশন শুরু করেছে। এই আন্দোলনকে সমর্থন করি আমরা। এর পর জেলায় জেলায় শুরু হবে। আমরাও কাল থেকে অনশন শুরু করব। এই আন্দোলন বৃথা হবে না। প্রশাসনকে বার্তা দিতে হবে।” কিন্তু সিনিয়র চিকিৎসকদের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিমধ্যে সমালোচনা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের এতদিনের কর্মবিরতিতে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো যথেষ্ট ধাক্কা খেয়েছে। দিনের পর দিন রোগীরা পরিষেবা পাননি। এখন তাঁরা কাজে ফিরলেও আন্দোলন রেশ থাকছেই। নতুন করে অনশন এবং তাতে সিনিয়রদেরও যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে ফের সেই অনিশ্চয়তা তৈরি হল। উৎসবের মরশুমে সরকারি হাসপাতালগুলিতে ফের চিকিৎসা পরিষেবা ব্যাহত হলে শেষমেশ তার কোপে পড়বেন সাধারণ, দরিদ্র রোগীরাই। একথা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে শাসকদল। তা সত্ত্বেও সিনিয়র চিকিৎসকদের অনশনের সিদ্ধান্ত স্বভাবতই সমালোচনার মুখে পড়ল।

এদিকে দেখা যাচ্ছে মানুষ ধীরে ধীরে উৎসবে ফিরছে। কিন্তু চারিদিক যখন উৎসবের আলোতে সেজে উঠেছে, তখন অন্ধকারেই রয়েছে আর জি করের নিহত চিকিৎসকের বাড়ি। নির্যাতিতার বাবা-মা তাঁদের মেয়ের বিচার পেতে পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত বাড়ির সামনে ধর্ণায় বসবেন বলে জানিয়েছেন। তাঁরা এও বলেছেন, “মঞ্চ বানিয়ে থাকব। এখানে মেডিক্যাল ক্যাম্পও বানাব”। মেয়ের স্মৃতিচারণ করে নির্যাতিতার মা জানিয়েছেন, “গতবছর পুজোর মধ্যেই হাসপাতালে ছুটে যেতে হয়েছিল। রোগী দেখাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নবমীর রাত এবং দশমীর সারাদিন হাসপাতালেই কাটিয়েছিল। ওঁর কাছে রোগীই ছিল প্রথম। কিন্তু বুঝিনি সেখানেই ওঁকে বলি হতে হবে। স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হবে কতগুলি দুষ্কৃতীর হাতে, বলি হতে হবে। প্রায় দু’মাস পরেও তাঁর বিচার মিললো না”। এরপরেই বাড়ির সামনে মঞ্চ করে পুজোর দিনগুলোতে ধর্ণায় বসার কথা জানান নির্যাতিতার পরিবার। তাঁরা জানিয়েছেন, “আমরাও অবস্থান করব। এত লোক যদি আমাদের জন্য রাস্তায় নামতে পারে, আমরা কেন নামতে পারব না। আমরাও সামনে একটা মঞ্চ বানিয়ে পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত থাকব। ওঁরাও (ডাক্তাররা) আসবেন বলেছেন। আমাদের এখানে মেডিক্যাল ক্যাম্প বানাবেন বলেছেন”।

অন্যদিকে শনিবার ধর্মতলায় আমরণ অনশনে বসেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অনুষ্টুপ মুখোপাধ্যায়, স্নিগ্ধা হাজরা, তনয়া পাঁজা, এসএসকেএমের অর্ণব মুখোপাধ্যায়, কেপিসি মেডিক্যাল কলেজের সায়ন্তনী ঘোষ হাজরা এবং এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের পুলস্ত্য আচার্য। সেই সময়ই দেখা যায় আরজি করের কেউ নেই। তখনই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে আরজি কর কাণ্ডের প্রেক্ষিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেখানে কেন সেই হাসপাতালের কেউ উপস্থিত নেই? এই প্রেক্ষিতে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিরোধের জল্পনাও উঠে এসেছিল। ঠিক এরই মধ্যে রবিবার অনশন মঞ্চে হাজির হলেন অনিকেত মাহাত। তিনি বলেন, ‘‘সবাই মিলে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। আরজি কর হাসপাতালের আন্দোলনের অন্যতম বিষয় থ্রেট কালচার। আর তার বিরুদ্ধে লড়াই। আমরা আন্দোলনের মধ্যেই আছি”। রবিবারই অনশন মঞ্চ থেকে জুনিয়র ডাক্তার দেবাশিস হালদার বলেন, ‘‘এই অনশনে আরজি কর সামিল নেই কেন, এই প্রশ্ন উঠেছে। কলেজ ভিত্তিক লড়াইয়ে আরজি কর ব্যস্ত ছিল। থ্রেট কালচারের মাথাদের শাস্তি দেওয়ার লড়াইয়ে বিগত কয়েকদিন আরজি করের জুনিয়র ডাক্তাররা ব্যস্ত ছিলেন।