গত এক দশক বা তার থেকে কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই ঘটেছে পার্কস্ট্রিট, কাটোয়া, কামদুনি, ধূপগুড়ি, মধ্যমগ্রামের মতো একাধিক ঘটনা। উল্লেখিত জায়গাগুলিতে যে একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলি ঘটেছে তার বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদ করেছে, মিছিলে হেঁটেছে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তুলেছে। কিন্তু আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ঘটনার পর যে প্রতিবাদের ঝাঁজ দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনের ঢেউ যেভাবে ছারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে তা নজিরবিহীন। কেবল তাই নয়, সময় যত এগোচ্ছে প্রতিবাদ আন্দোলনে নানা দিকের নানা ধরনের মানুষ শামিল হচ্ছেন সুবিচারের দাবিতে। আন্দোলন ঠেকাতে শাসক তথা প্রশাসনের তরফে যত সুকৌশলি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সাধারণ মানুষ তত ক্ষেপে উঠছে। প্রশ্ন উঠছে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ঘটনা কেন এমন জনরোষের জন্ম দিল? সে প্রশ্ন শুধু যে বিশিষ্ট মানুষজনদের চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তা নয়, শাসক ও শাসকদলের অন্দরেও ঘোরা ফেরা করছে। সাধারণত শাসকদল ও সরকারের মধ্যে বিশেষ কোনও ফারাক থাকেনা, তবে কি শাসক দল ও সরকার তথা প্রশাসনের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে?

প্রসঙ্গত, ৯ অগাস্ট আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক ধর্ষণ করে খুন হওয়ার পর ‘নিরপেক্ষ তদন্ত’, ‘ন্যায় বিচার’, ‘দোষীর শাস্তি’, এবং হাসপাতালে নিরাপত্তাসহ বেশ কয়েকটা দাবি নিয়ে প্রতিবাদে শামিল হয় সেই নিহত চিকিৎসকের কলেজের সহপাঠী এবং অন্যান্য জুনিয়র চিকিৎসকরা। তারপর প্রতিবাদে একে একে সামিল হন সাধারণ মানুষ, নাগরিক সংঠন, ছাত্র, দেশের অন্যান্য প্রান্তের ডাক্তার, চিকিৎসাকর্মী, ফুটবল মাঠের সমর্থক, নিহত চিকিৎসকের জন্য বিচার চেয়ে প্রতিবাদে স্বর মেলান চিত্রকরেরা এবং আরও নানা ধরনের মানুষ। এখনো পর্যন্ত আন্দোলনের যে তীব্রতা দেখা যাচ্ছে তাকে এক কথায় নজিরবিহীন বলেই মনে করছেন সবাই। কিন্তু আন্দোলনের এত তীব্রতা কেন আর কেনই বা এত জনরোষ? মানুষের পিঠ ঠেকে গেলে বোধহয় এমনটাই হয়। পার্কস্ট্রিট থেকে শুরু করে পরপর যে কটা ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা হয়েছে সেখানে হয় ঘটনাকেই অস্বীকার করা হয়েছে, তা না হলে নির্যাতনের শিকারকেই দায়ী করা হয়েছে। কোথাও বিরোধীদের চক্রান্ত বলা হয়েছে কোথাওবা দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা চলেছে। এইসব দেখতে দেখতে মানুষ ধৈর্য হারিয়েছে। আরজি করের ঘটনার পর অনেকদিনের জমা ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপ নিয়েছে, তাই মানুষ পথে নেমেছে। প্রশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে ক্ষোভ জমা ছিল তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছেও। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে একের পর এক দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার বিষয়টিও, যা এই আন্দোলনের তীব্রতার একটি অন্যতম কারণ।

এই যে একটা কিছু ঘটলেই শাসকের হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সঙেরা, চটি-জুতো চাটারা গলার স্বর নামিয়ে, মৃদু হাসিমাখা মুখে বলেন, বিগত জমানায় ওখানে এই হয়েছিল, সেখানে কী বীভৎস কাণ্ড, তার বিচারতো আজও হল না? আসলে ছুড়ে দেওয়া অনুদান আর ভিক্ষে পেতে পেতে ওরা যে কেবল মেরুদন্ড ও মাথা বন্দক দিয়েছে তা তো নয়, তারা মনুষ্যত্ব হারিয়েছে। তাই ক্ষমতা প্রদর্শন করতে ধর্ষণ, বিচার চাইলে ধামা চাপা দেওয়া, চুরি জোচ্চুরিকে রীতি, দুর্নীতিকে নীতি বলে গ্রাহ্য করাতে যে শাসক দীর্ঘদিন ধরে মরীয়া চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের আর মেনে নেওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আরজি কর ঘটনার প্রতিবাদে তারা যোগ দিয়েছেন, রাত দখলের কর্মসূচিতে কাতারে কাতারে মানুষের সমাগম, মিছিলে পা মেলাচ্ছেন যারা তাদের মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিবাদের অন্য ভাষা। তারা সহজ বাক্যেই বলছেন, এই আগুন সহজে নেভার নয়। কারণ এটা একদিনে তৈরি হয়নি। মানুষের সহ্যের একটা সীমা আছে, সেই বাঁধ কিন্তু ভেঙ্গে গিয়েছে।

আজ সাধারণ মানুষ এই ঘটনার সঙ্গে নিজের পরিস্থিতিকে মেলাতে পারছেন। তারা বুঝতে পারছেন এই ঘটনা যে কারও সঙ্গে ঘটতে পারে এবং ঘটছেও। বিচার সহজে মিলবে না। তারা এটা বুঝেছেন নিজেদের অধিকার নিজেদেরই বুঝে নিতে হবে। সাধারণ মানুষের ভিতরের ক্ষোভ একদিনে প্রকাশ পায় না, কিন্তু জমে থাকা বিরক্তি-ঘেন্না-রাগ একদিন স্ফুলিঙ্গ হয়, বাম জমানাতেও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময়েও মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, রিজওয়ানুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পথে নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক বিকল্প কোথায়? নেই বলেই ফায়দা নিচ্ছে একটা আপাদমস্তকচোরজোচ্চরচিটিংবাজঅশিক্ষিতঅসংস্কৃতপূর্ণ দল তথা সরকার, সেটা সাধারণ মানুষ অনেক আগেই হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিল, তখন থেকেই জমছিল ক্ষোভ জমা হতে হতে তীব্র জনরোষের আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাত দখলে লাখ লাখ মানুষ যোগ দেওয়ার পর সল্টলেকে ফুটবল প্রেমীদের নজিরবিহীন প্রতিবাদ ইত্যাদির পর সাধারণ মানুষ কোথাও একটা যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন। তাই স্কুল পড়ুয়া থেকে প্রাপ্তবয়স্ক জনানীগুণীবিদ্বান সবারই মনে হয়েছে বিচার নেই, তাই সবাই সমস্বরে বলছেন “বিচার চাই”। একটা নির্বাচনও নিরপেক্ষভাবে হয়না, ভোট লুঠ হয়, শিক্ষাক্ষেত্র থেকে স্বাস্থ্য, নিয়োগ থেকে বন্টন সর্বত্রই দুর্নীতি, কেবলমাত্র আরজি কর নয়, দুর্নীতিকে নীতিতে পরিণত করার আপ্রাণ চেষ্টা-সহ একাধিক বিষয় আসলে এই জনরোষের কারণ।
