পরশুরামের বাবা জমদগ্নি মুনি একদিন দুপুর বেলায় তীর-ধনুক চালনা অভ্যাস করছেন। তাঁর স্ত্রী রেণুকা ছুটে ছুটে গিয়ে তীরগুলি কুড়িয়ে আনছিলেন। বার বার ছুটে ছুটে যাওয়া আসা করতে করতে রেণুকা খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েন।জমদগ্নি বোঝেন সূর্যের প্রখর তাপের কারণেই রেণুকার এমন অবস্থা। তিনি সূর্যকে লক্ষ্য করে তীর ছুড়তে উদ্যত হওয়া মাত্র ছুটে এলেন আদিত্যদেব, সঙ্গে আনলেন চর্মপাদুকা আর রৌদ্রজলবারনাথম ছত্র। জুতো ও ছাতার এই জন্মকাহিনি মেলে মহাভারতে। এছাড়া ছাতার উল্লেখ মেলে রামায়ণ, হর্ষচরিত, কাদম্বরী, দশকুমার চরিত প্রভৃতিতে। কালিদাসের দুষ্মন্ত বলেছিলেন- ‘রাজ্যং স্বহস্তধৃতদন্ডমিরাতপত্রম’ অর্থাৎ প্রকান্ড ভারি ছাতা সর্বক্ষণ নিজেকে বইতে হলে যেমন আরামের চেয়ে পরিশ্রম বেশি হয়, তেমনি রাজত্ব করাও অবসরবিহীন শ্রমের কাজ। সেকালে প্রায় সব রাজদরবারে ছাতা ধরার কাজ করতেন মহিলারা। অজন্তার গুহাচিত্র থেকে শুরু করে মধ্যযুগের মোগল আর রাজস্থানী চিত্রকলাতেও রাজার পার্শ্বচর হিসাবে স্থান পেয়েছে ছত্রধারিণীরা।

ছাতা রাজা এবং তার রাজ্যকে অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করে, এই হল প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাস। ছত্রছায়ায় রাজা বীরবিক্রমে রাজকার্য করেন। ছাতার ছায়ায় রাজ্যে দুঃখ কষ্ট ঠাই নিতে পারেনা। পুরাণের গল্পে যক্ষরাজ কুবেরের মাথায় ছাতা ধরার উল্লেখ আছে। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় ডাইনোসিয়াসের পুজোতে ছাতার ভূমিকা ছিল। ৩৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রিক নাট্যকার এরিস্টোফেন্স রচিত নাটক ‘দ্য বার্ডস’-এর একটি দৃশ্যে নাটকের অন্যতম চরিত্র প্রমিথিউস যখন পিসটেথেরাসকে স্বর্গের একটি ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন তিনি পিসটেথেরাসকে বলেন, ‘ছাতা দিয়ে আমাকে আড়াল করে রাখো যাতে জিউস আমাকে দেখতে না পায়’। ছাতা আছে কয়েক হাজার বছর ধরে। ছিল প্রাচীন গ্রীসে রাজপরিবারের লোকের মাথায়। অবশ্য সে ছাতার আকার ছিল বিচিত্র। তিন ফুট লম্বা সোনার দন্ডের ওপরে হীরা-মতি জড়ানো মখমল বসানো ছাতা ছিল। সে ছাতা বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নয়। কালীঘাট মন্দিরে রাজা নবকৃষ্ণ দেব সোনার ছাতা দিয়েছিলেন। মাদুরায় আছে মুক্তো বদানো ছাতা মীনাক্ষীদেবীর মন্দিরে। বহু বনেদি বাড়ির ঠাকুরঘরে পেতলের সিংহাসনে পেতল বা রূপোর ছাতা মাথায় শালগ্রাম বা শিবলিঙ্গ কিংবা গোপাল দেখা যায়।

পুরনো কাশীর ছবিতেঘাটে পান্ডা পুরোহিতদের বিশাল ছাতার নীচে বসে থাকতে দেখা যায়। কলকাতার প্রাচীন ছবিতে ছাতার তলায়মেম সাহেবরা চৌরঙ্গি এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সেই বিশাল ছাতা ধরে আছে এ দেশের ছাতাবরদার। সেকালে সেটাও এক ধরনের পেশা ছিল। একালের মতো সকলেই ছত্রপতি ছিলেন না। তখন সাধারণ মানুষ ছাতা ব্যবহার করার কথা ভাবতে পারতেন না কিংবা নিজস্ব ছাতা রাখার সামর্থও ছিল না। পুরাকালে দেবতা বা রাজা মহারাজাদের মাথার ওপরই ছাতা থাকতো। রাজ চক্রবর্তী ছাতা মাথায় চলতেন আর সেই ছাতা ধরে রাখতো ছত্রবাহক। রাজকীয় ছাতার আবার ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল। রাজার মাথার ছাতার নাম ছিল ‘ওস্তাদ’। যুবরাজের ছাতার নাম ছিল ‘প্রতাপ’। সভাসদদের ছাতার নাম ছিল ‘কণকদন্ড’। রাজছত্রের দৌলতেই শিবাজীর নাম হয়েছিল ছত্রপতি। ১৭৩০ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরের ছাত্রদের ব্যবহারের জন্য একটি মাত্র ছাতা ছিল এবং সেটি ব্যবহার করতে হলে এক সপ্তাহ আগে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হত। তবে সম্মানীয় ব্যক্তির সামনে ছাতা ব্যবহার করাটাও ছিল অপরাধ। একসময় বাংলাদেশে আর ওড়িশায় বিধবাদের মধ্যে জুতো আর ছাতা এই দুইয়ের ব্যবহারই ছিল নিষিদ্ধ।

ছাতা প্রথম কোথায় আবিষ্কার হয়েছে এই নিয়ে অনেক মত আছে। কেউ বলেন চিনে, অনেকে আবার মিশর, গ্রিসের কথাও বলেন। এই তিন দেশের প্রাচীন চিত্রকলায় ছাতার দেখা মেলে। তবে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ছাতার আকৃতি যেমন বিরাট ছিল তেমনি ওজনও ছিল বেশি। একেকটি ছাতার ওজন হত ৪-৫ কেজি।কারণ তখন ছাতার রড তৈরি হত কাঠ অথবা তিমি মাছের কাঁটা দিয়ে। হাতলগুলো ছিল দেড় মিটার লম্বা। চীনে প্রথম ছাতা আবিষ্কার হলেওব্যবহার করতে পারতো মেয়েরা। তবে শুধুমাত্র সমাজে আর্থিক ভাবে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরাই ছাতার ব্যবহার করতেন। ছেলেদের হাতে ছাতা উঠেছে অনেক পরে। বিশ্বে প্রথম ছাতার দোকান তৈরি হয় ১৮৩০ সালে লন্ডনের ৫৩ নিউ অক্সফোর্ড স্ট্রিটে, নাম “জেমস স্মিথ অ্যান্ড সন্স”। আজকের আধুনিক ছাতা আবিস্কার হয় ১৮৫২ সালে। সে বছরেই সুইচের সাহায্যে ছাতা খোলার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন গেজ বা গেড নামের এক ফরাসি। এরপর জার্মান হ্যানস হাপট ১৯২০ সালে পকেটে বহনযোগ্য ছাতা তৈরি করেন, নাম “লর্ড অ্যান্ড লেডি”। তবে পলেস্টার কাপড়ের ছাতার চল শুরু হয় ১৯৬০ সালে।

আমেরিকাতে ফোল্ডিং ছাতার আবিষ্কার হয় ১৭৩৪ সালের ৫ আগস্ট। যে ঘটনাকে মনে রেখে আমেরিকার ছোটোরা প্রতি বছর ৫ আগস্ট ‘ছাতা দিবস’ পালন করে। কেউ কেউ আবার বলেন যে, পারস্যের এক কারিগরের হাতেই ১৭১৫ সালে ফোল্ডিং ছাতার আবিষ্কার হয়েছিল।
5 Comments
ভালো লেখা বা টপিক । বাঁচা গেল। আমি ভাগ্যিস সম্ভ্রান্ত ন্যাংটো থেকেই এবং নিজ অধিকারে ছিল বহুবর্ণ ছাতা ।
আচ্ছা আদিত্যদেবের ওই রুষ্ট অবস্থা শান্ত করার মন্ত্রটা পাওয়া যাবে ?
অনবদ্য কাহিনী
জানা হল। ধন্যবাদ।
দুর্দান্ত লেখা। তোমার কাছ থেকে কত কি জানতে পারি।
আজকে অফিসে এসেই নিশ্চিত হলাম, একটা brand new ছাতা হারিয়েছি, তারপর দেখি, না, এ লেখায় তো ছত্রে ছত্রে ছাতা।