কলকাতা ব্যুরো: রাজ্যে প্রবল কালবৈশাখীর তাণ্ডবের জেরে প্রাণ গেলো ৬ জনের। কলকাতায় ঝড়বৃষ্টির জেরে কলেজ স্ট্রিট এলাকায় গাছ ভেঙে পড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে, বর্ধমানেও গাছ ভেঙে এক ১৪ বছরের বালকের মৃত্যু হয়েছে। জানা গিয়েছে মৃতের নাম সেখ আলিসান, বয়স ১৪ বছর। ঘটনাটি ঘটেছে বর্ধমান শহরের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের হরেরডাঙা এলাকায়। তীব্র বেগে ঝড়ের জেরে গাছ পরার ঘটনায় আহত হয়েছে আরও তিনজন। তাঁদের চিকিৎসা চলছে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এদিন কলকাতার পাশাপাশি হাওড়া, হুগলী, উত্তর ২৪ পরগণা, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়্গ্রাম, বাঁকুড়া, পূর্ব বর্ধমান ও নদীয়া জেলায় বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া গিয়েছে।


এছাড়াও ঝড়ের মাঝেই রোয়িং করতে গিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে তলিয়ে যায় দুই কিশোর। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে খোঁজাখুজির পরও তাঁদের কোনও হদিশ পায়নি বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। শেষ পর্যন্ত ওই দুই কিশোরের দেহ উদ্ধার হয় সরোবরের লেক থেকেই। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁদের মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। জানা গিয়েছে, শনিবার রবীন্দ্র সরোবরে রোয়িং করতে নেমেছিলেন চার কিশোর। ঝড়ের সময় রোয়িং বোটে থাকা চারজনের মধ্যে দু’জন তলিয়ে যায়। জানা গিয়েছে, মৃতদের মধ্যে একজন সাউথ পয়েন্টের ছাত্র। অপর মৃত পড়ুয়া এক পুলিশকর্তার ছেলে বলে জানা গিয়েছে। এদিকে ঘটনার খবর পেয়েই পৌঁছণ রাজ্যের মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম এবং কেএমডিএ-র সিইও অন্তরা ভট্টাচার্য।


স্কুল পর্যায়ের রোয়িং প্রতিযোগিতার ফাইনাল রবিবার রবীন্দ্র সরোবরেই হওয়ার কথা ছিল। বস্তুত সেই কারণে বেঙ্গল রোয়িং ক্লাব, লেক ক্লাব, ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবের ৫টি বোট শনিবার বিকেল থেকে সরোবরে নামানো হয়েছিল। প্রতিটি বোটে ৫ জন করে স্কুল ছাত্র অনুশীলন করছিল। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আচমকাই কালবৈশাখীর ঝড় প্রায় ৯০ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়ে। আর সেই ঝড় সামলাতে না পেরে ৫টি বোটই উলটে যায়। কিন্তু সকলেই সাঁতরে উপরে উঠে এলেও দীর্ঘক্ষণ জলে নিখোঁজ ছিল ওই দুই ছাত্র- পূষণ সাধুখাঁ এবং সৌরদীপ চট্টোপাধ্যায়। দুজনেরই বয়স ১৪ বছর বলে জানা গিয়েছে।
খবর পেয়ে রবীন্দ্র সরোবর থানার পুলিশ, দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী এবং ডুবুরি নামানো হয়। সন্ধে সাড়ে সাতটার কিছু পরে দুই কিশোরের নিথর দেহ জল থেকে উদ্ধার করেন দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীরা। এছাড়াও ভাতারে বজ্রপাতে একজনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। শ্রীরামপুরেও একজনের প্রাণহানি হয়েছে বলে খবর।


শনিবার দুপুরেই শহরে ঘনিয়ে আসে কালো অন্ধকার। বিকেল হতে না হতেই ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যায় শহরের আকাশ। শুরু হয় কালবৈশাখীর ভয়ানক তাণ্ডব। মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতা জুড়ে ঝমঝম করে শুরু হয় বৃষ্টি। সঙ্গে চলে বজ্রপাত। তুমুল বৃষ্টির জেরে কলকাতার একাধিক এলাকা ইতিমধ্যেই জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।

শহরের একাধিক জায়গায় গাছ ভেঙে পড়েছে বলে খবর। ঝড় বৃষ্টির প্রভাবে বেহালা রায়বাহাদুর রোডের একটি রাস্তায় রিক্সার মধ্যে ভেঙে পড়ে বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ। তবে অল্পের জন্য রিক্সাচালক প্রাণে বেঁচেছেন বলে খবর। ঘটনাস্থলে বেহালা থানার পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে।
দেশপ্রিয় পার্ক, সাদার্ন অ্যাভিনিউ, লেক মার্কেট এলাকায় গাছ ভেঙে পড়ার খবর মিলেছে। এদিকে, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের প্রেস বক্সের একাংশ ভেঙে পড়েছে বলে জানা যাচ্ছে। অফিস ফেরত যাত্রীদের তুমুল বৃষ্টিতে রাস্তায় আটকে পড়েছেন। প্রিন্স আনওয়ার শাহ রোড, লর্ড সিনহা রোড থেকে শুরু করে আলিপুর, বেহালা তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে। প্রবল ঝড়ে দৃশ্যমাণতা ক্ষীণ হওয়ায় গাড়ি যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে। টালিগঞ্জ-গড়িয়া মেট্রো পরিষেবাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ব্যাহত হয়েছে বিমান পরিষেবাও।


জানা গিয়েছে, ঝড়ের তান্ডবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে টালিগঞ্জ ও কবি সুভাষ মেট্রো চলাচল। মেট্রো চলছে দক্ষিণেশ্বর থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত। তবে বিকেল সাড়ে ৫টার পর থেকে অবশ্য স্বাভাবিক হয়েছে বলে মেট্রো রেল সূত্রে খবর। সপ্তাহান্তে কলকাতা ও সংলগ্ন জেলাগুলিতে কালবৈশাখী হতে পারে এমন পূর্বাভাস আগে থেকেই ছিল। শনিবার বিকেল হতে না হতেই সেই পূর্বাভাস সত্যি হয়ে গেল। দিনের আলোর মাঝেই নামল ঘন আঁধার। মেঘাচ্ছন্ন হয়ে নামল বৃষ্টি, সঙ্গে ঝড়। প্রতি মুহূর্তে বাড়লো ঝড়ের গতিবেগ। ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়ায় তছনছ হয়েছে কলকাতা, হাওড়া, হুগলির একাধিক এলাকা। বলা হচ্ছে, মরশুমের সবচেয়ে শক্তিশালী কালবৈশাখী এটি।


আবহাওয়াবিদ রবীন্দ্র গোয়েঙ্কা জানিয়েছেন, এদিন কালবৈশাখীর ঝঞ্ঝা রেখা বিস্তৃত ছিল উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ থেকে ওড়িশার বালেশ্বর পর্যন্ত। এদিনের হাওয়ার সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। স্থানভেদে ১৫ – ২০ মিমি বৃষ্টি হয়েছে এদিনের দুর্যোগে।
এদিকে কলকাতা বিমানবন্দর এলাকাতেও খুব কম সময়ের মধ্যে জল থইথই হয়ে যায়। তুমুল ঝড়বৃষ্টির কারণে সুরক্ষার কথা ভেবে বন্ধ রাখা হয় উড়ান। এই মুহূর্তে দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কোনও বিমান ওঠানাম করছে না বলেই খবর।
অন্যদিকে আইপিএল-এর প্লে-অফের ঠিক দু’দিন আগেই শহরে কালবৈশাখী। তছনছ ক্রিকেটের নন্দন কানন। ঝড়ের দাপটে উড়ে গিয়েছে ইডেনের গ্রাউন্ড কভার। স্টেডিয়ামের বেশ কিছু অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্লে-অফের আগে শনিবার ইডেনে যে অনুশীলন পর্ব ছিল, সেটাও বাতিল করা হয়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, প্লে-ফে খেলার জন্য শনিবারই শহরে আসার কথা ছিল ঋদ্ধিমান সাহা, মহম্মদ শামি-সহ গুজরাট টাইটান্সের তারকাদের। কিন্তু তাঁদের বিমান এদিন ঝড়ো হাওয়ার জন্য শহরে নামতে পারেনি বলে খবর। আগামী মঙ্গলবার ইডেনে প্লে-অফের প্রথম ম্যাচ। যে ম্যাচে গুজরাট টাইটান্সের মুখমুখী হবে রাজস্থান রয়্যালস। সেই ম্যাচের আগে মোটামুটি প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল ইডেনে। শুধু প্লে-অফের জন্যই আনানো হয়েছিল বিশেষ গ্রাউন্ড কভার। কিন্তু শনিবারের ঝড়ো হাওয়ায় সবটাই তছনছ হয়ে গেল। জানা গিয়েছে, যে বিশেষ গ্রাউন্ড কভার আনা হয়েছিল, সেটা উড়ে যাওয়ায় মাঠ ভিজে গিয়েছে। একাধিক জায়গায় গ্যালারির শেডও ভেঙে গিয়েছে বলে খবর।

তবে কালবৈশাখীর প্রভাব যে শুধু ক্রিকেট মাঠেই পড়েছে, সেটা নয়। এর প্রভাব পড়েছে ফুটবল মাঠেও। শনিবারই যুবভারতীতে এএফসি কাপের ম্যাচে বসুন্ধরা কিংসের মুখোমুখী হয়েছে মোহনবাগান। কিন্তু খেলা শুরুর ১১ মিনিট পর ঝড়ো হাওয়ার জন্য সেই ম্যাচও স্থগিত করে দেওয়া হয়। প্রায় ৪৫ মিনিট খেলা বন্ধ থাকার পর খেলা আবারও শুরু হয়।