আমতার ছাত্রনেতা আনিস খানের মৃত্যু ঘিরে বাংলার নিস্তরঙ্গ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ফের উত্তপ্ত। বাংলা উত্তাল আমতার ছাত্রনেতার মৃত্যু রহস্যের যথাযথ তদন্তের দাবিতে। বিক্ষোভের আঁচ সামাল দিতে পুলিশের ভূমিকায়, শাসকের আচরনে উঠছে হাজার প্রশ্ন,মনে করিয়ে দিচ্ছে দেড় দশক আগের রিজওয়ানুর রহমানের ঘটনা। আনিস খানের মৃত্যুর পর যেভাবে ফুঁসছে মহানগর, রিজওয়ানের মৃত্যুতেও পনেরো বছর আগে একইরকম ভাবে কলকাতার রাজপথে ছিল কান্না আর ক্রোধ।
দুটি ঘটনার মধ্যে প্রায় ১৫ বছরের ফারাক কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় এমন কিছু মিল রয়েছে, যা আনিসের সঙ্গে রিজওয়ানুরকে মিলিয়ে দিচ্ছে। উল্লেখ, আনিস খানের মৃত্যু তদন্তে সিটের নেতৃত্বে যিনি রয়েছেন, সেই জ্ঞানবন্ত সিংয়ের বিরুদ্ধেই রিজওয়ানুর মামলায় অভিযোগ উঠেছিল।আনিসের মৃত্যুর ঘটনায় যেমন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, একইভাবে প্রশ্ন উঠেছিল রিজওয়ানুরের মৃত্যুতেও। রিজের পরিবার শুরু থেকেই অভিযোগ করেছিল, তাঁকে খুন করা হয়েছে। পুলিশের তরফে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার আগেই জানানো হয়েছিল, খুন নয়, আত্মহত্যাই করেছেন রিজওয়ানুর। যদিও পরবর্তীতে সিবিআই তদন্তে নেমে জানায়, ঘটনাটি আত্মহত্যা, তবে তাতে প্ররোচনা ছিল। একইভাবে আনিসের মৃত্যুতেও দেখা গেল ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসার আগেই পুলিশ মদ্যপ থাকার তত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা করেছে।
পুলিশ আনিসের মৃত্যু হয়েছে জানার পরও জেনারেল ডায়েরি করেনি, ঘটনাস্থলে পৌঁছায়নি নজরদারি বাহিনী। আমতা থানা আনিসের বাড়ির দূরত্ব গাড়িতে ১০ মিনিট৷ঘটনার রাতে আনিস নিহত হওয়ার পর তার বাড়ির কাছের রাস্তায় কোনো সিসিটিভির দেখা মেলেনি৷ তবে কি হত্যাকারীদের যাতে চিহ্নিত করা সম্ভব না হয় সে কারণেই জেনে বুঝে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল? কে বা কারা করতে পারে এমন কাজ? এছাড়া ঘটনার ৯ ঘণ্টার মধ্যে স্নিফার ডগ ঘটনাস্থলে যায়নি, জায়গা ঘেরা হয়নি, নমুনা নেওয়া হয়নি, ময়নাতদন্তের সময় পরিবারের কেউ ছিল না, ময়নাতদন্তের ভিডিওগ্রাফি করা হয়নি৷ এমন আরও বহু প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ প্রশাসনের দিকেই।


রিজওয়ানুরের ঘটনায় বাংলার তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাস্তায় নেমে সুর চড়িয়েছিলেন। ন্যায়বিচারের দাবিতে নাগরিক সমাজের সঙ্গে কলকাতার রাজপথে হেঁটে ইনসাফের দাবি তুলেছিলেন। নাগরিক সমাজের এবং বিরোধী শিবিরের ক্রমাগত চাপে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, তৎকালীন পুলিশ কমিশনার প্রসুন মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানবন্ত সিং ও অজয় কুমার সহ পাঁচজন পুলিশ কর্তার ভূমিকা সন্দেহভাজন ছিল।
আনিশের মৃত্যুতেও ক্ষোভ-বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনযেমন, পাশাপাশি রাজনীতির বাইরে থাকা বহু সাধারণ ছাত্রছাত্রীওআনিসের মৃত্যুর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। অথচ কলকাতা-সহ বাংলার বিভিন্ন জেলায় আনিসের মৃত্যু ঘিরে এই উত্তাল আন্দোলনকে সেদিনের বিরোধীনেত্রী আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়তীব্র কটাক্ষ করছেন। নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী তোপ দেগে দিলেন, ‘একটা ঘটনা ঘটেছে। সরকার তার নিরপেক্ষ তদন্ত করছে। দুই পুলিসকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পাবে। তাই বলে আন্দোলন করে সব স্তব্ধ করে দিতে হবে? রাস্তা অবরোধ করে হাজার হাজার মানুষকে বিপাকে ফেলতে হবে?’ পনেরো বছর আগের সেই আন্দোলন কি সব স্তব্ধ করে দেয়নি, সেদিনও কি রাস্তা অবরোধে হাজার হাজার মানুষ বিপাকে পড়েনি? আজ মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘আন্দোলন করে আমি আজ এই জায়গায় উঠে এসেছি। দয়া করে আমাকে কেউ আন্দোলন শেখাতে আসবেন না।’ কেবল তাই নয়, মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, ‘তদন্তে বাধা দেওয়াও কিন্তু ক্রিমিনাল অফেন্স। এটা মাথায় রাখবেন।’


রাজ্য সরকারের সিটের উপর আনিসের পরিবার ভরসা রাখতে পারছে না। তারা সিবিআই তদন্তের দাবিতে অনড়। ঠিক যেমন ক্ষমতায় আসার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা ঘটনায় কথায় কথায় সিবিআই তদন্ত দাবি করতেন। কিন্তু এখন সেই সিবিআই তদন্তে তাঁর আপত্তি কেন? ১৫ বছর আগে রিজওয়ানুর কাণ্ডে তখনকার বিরোধী দলনেত্রী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। একইভাবে আজ পুলিসমন্ত্রী হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি উঠেছে। তিনি অবশ্য এর জবাব দিতেও দেরি করেননি- যাঁরা এখন বড় বড় কথা বলছেন, তাঁরা নিজেদের আমলে কত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন? সিঙ্গুরে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? উত্তরপ্রদেশের হাথরস, উন্নাও-এর ধর্ষণ কাণ্ডে কতজনের শাস্তি হয়েছে? আজ পর্যন্ত সিবিআই বিশ্বভারতী থেকে চুরি যাওয়া নোবেল প্রাইজ উদ্ধার করতে পেরেছে?
তবে প্রতিবাদ আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি আনিসের মৃত্যুরহস্যের যথাযথ তদন্তের দাবি সেটা বুঝিয়ে দিল। ফিরিয়ে দিল ১৫ বছর আগের রিজওয়ানুর রহমানের রহস্যজনক মৃত্যুর স্মৃতি। সেদিন বাম সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এমন বহু মুখ রাস্তায় মিছিল করেছিলেন যাদের অধিকাংশ এখন তৃণমূল শিবিরে। সেই মুখগুলি অবশ্য আজ আর আনিস কাণ্ডের প্রতিবাদে পথে নেই।
4 Comments
কখনও জিঙ্গাসাবাদের নামে থানায় ডেকে এনে পিটুনি এবং মৃত্যু, কখনও পুলিশ পরিচয় দিয়ে জোর করে বাড়ি ঢুকে পড়া, অত্যাচার করা এবং পরিণতি সেই একই- বারবার অভিযোগের আঙুল উঠছে যে উর্দির দিকে সেটা মানুষ গায় চাপায় কীভাবে, তার চেয়ে বর কথা ওই সব অসামাজিকরা এখনও কিভাবে সমাজের এক ধারে হলেও জায়গা পায়?
নাগরিক সমাজ কি ঠিক সেই ভাবে ফুসে উঠবে, পথে নামবে যাতে আর কোনও আনিশ কিংবা রিজুয়ানুরের মৃত্যুর ঘটনা না ঘটে, যাতে সমাজে আর পুলিশ নামক কৃমি কিম্বা কিটের জন্ম না হয় এবং অবশ্যই পচা খালের পার থেকে কোনও দুর্গন্ধ ভেসে না আসে?
তার মানে আজ যিনি সরকার কিম্বা প্রশাসনের কঠিন সমালোচনা করছেন কাল তিনি ক্ষমতা পেলে মানুষের দাবিকে পিষে মারতে পুলিশ লেলিয়ে দেবেন- এটাই কি এখন রাজ্য রাজনীতির ঐতিহ্য? কবে শুরু হল ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী নিয়ে রাজনৈতিক শাসন? গত শতকের আটের দশক থেকে মানে বাম জমানায়। তাদের শিক্ষটা তৃনমূল খুব ভাল রপ্ত করেছে, দলটা তো ভাঙ্গানো সিপিএমের লোকজন দিয়েই তৈরি।
প্রায় সব ঘটনা নিয়েই যারা নিজের নিজের সুবিধা অনুযায়ী মন্তব্য করেন, দরকার মতো রাস্তায় নেমে মিছিলে হাঁটেন, কি বলছেন সেই সব বুদ্ধিজীবীরা? কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা নিয়েই তাঁরা মুখ থেকে শব্দ বের করেছেন, আনিশের ক্ষেত্রেও বলেছেন তবে এতটাই আস্তে যে তাতে কোনও ধার নেই, তাতে কারও কিছু যায় আসে না।