কলকাতা ব্যুরো: সঙ্গীত জগতে ফের এক নক্ষত্রপতন। চলে গেলেন বর্ষীয়ান সুরকার-গায়ক বাপ্পি লাহিড়ী। মঙ্গলবার রাতে মুম্বইয়ের এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে মুম্বইয়ের ক্রিটিকেয়ার হাসপাতালের ডিরেক্টর ড. দীপক নমযোশী জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন প্রবীণ সংগীত পরিচালক। একাধিক শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। ভর্তি হতে হয়েছিল ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে। সেখান থেকে সোমবার ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু মঙ্গলবার থেকে ফের তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এরপরই তাঁকে ক্রিটিকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। জানা গিয়েছে, সেখানেই মধ্যরাতে প্রয়াণ ঘটে প্রবীণ শিল্পীর। OSA তথা অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিতে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

তবে বুধবার শেষকৃত্য হচ্ছে না বাপ্পি লাহিড়ীর। বর্তমানে লস অ্যাঞ্জেলসে রয়েছেন তাঁর পুত্র বাপ্পা লাহিড়ী। বাবার মৃত্যুর খবর শুনেই তড়িঘড়ি রওনা দিয়েছেন সেখান থেকে। তবে এদিন রাত ২টোর আগে তিনি দেশে পৌঁছতে পারবেন না। ফলে বুধবার তাঁর অন্তেষ্টি সম্ভব নয়। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার শেষকৃত্য হবে কিংবদন্তী এই সংগীতশিল্পীর। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার জুহুতে পবনহংস মহাশ্মশানে বাপ্পি লাহিড়ীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।
একেবারে ছোটবেলা থেকেই সাংগীতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা। বাবা ও মা দু’জনেই ছিলেন সংগীত জগতের মানুষ। ৩ বছর বয়সে তবলা বাদক হিসেবে কেরিয়ার শুরু। ২০২০ সালে ‘বাগী ৩’ ছবিতে ‘ভাঙ্কাস’ গানটিই ছিল তাঁর শেষ কাজ। মাঝের দীর্ঘ সময়ে সুরকার তো বটেই, কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও যে অবদান তিনি রেখে গেলেন তা অবিস্মরণীয়। মঙ্গলবারের সন্ধ্যা কেড়ে নিয়েছিল প্রবাদপ্রতিম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চলে গেলেন বাপ্পি লাহিড়ীও। শোকের ছায়া আরও ঘন হলো সংগীত জগতে।

সুরকারের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। টুইট করে দুঃখপ্রকাশ করেছেন বাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়। বুধবার সকালে টুইটারে শোকপ্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী লেখেন, বাপি লাহিড়ীর মিউজিকে জাদু ছিল, কতরকমের অভিব্যক্তি ছিল। সব প্রজন্মের মানুষের কাছেই তাঁর গান সুপারহিট। ছিলেন অত্যন্ত প্রাণবন্ত। গোটা দেশ তাঁর প্রয়াণে শোকাহত। বাপি লাহিড়ীর পরিবারের প্রতি সহানুভূতিও জানিয়েছেন মোদী।
অন্যদিকে মমতা টুইট করেন, কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী, গায়ক-সুরকার বাপ্পি লাহিড়ীর প্রয়াণের খবরে আমি শোকস্তব্ধ। উত্তরবঙ্গের ছেলে বাপ্পি লাহিড়ী নিজের প্রতিভা ও কঠোর পরিশ্রমে খ্যাতির সোপান বেয়ে মুগ্ধ করেছিলেন গোটা ভারত তথা বিশ্বকে। সংগীত জগতে তাঁর অবদান আমাদের গর্বিত করেছে।
এখানেই শেষ নয়, মুখ্যমন্ত্রীর আরও সংযোজন, এমন সঙ্গীত ‘জিনিয়াস’-এর অবদানকে সম্মানিত করতে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার ‘বঙ্গবিভূষণ’-এ সম্মানিত করা হয় তাঁকে। শিল্পীর পরিবারের প্রতি রইল আমার সমবেদনা।
টুইটার হ্যান্ডেলে শোকজ্ঞাপন করেছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও। শোকাহত তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এই কঠিন সময়ে তাঁর পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন প্রত্যেকেই।

তিনি ডিস্কো কিং। তাঁর সুর দেওয়া গান মানেই নতুন ট্রেন্ড। ‘ডিস্কো ডান্সার’, ‘ডান্স ডান্স’ ছবির গানে আজও হইচই ওঠে যে কোনও ক্লাবে, ডিস্কো থেকে। তাঁর সুরে পা স্থির রাখা খুব কঠিন। সত্তর থেকে আশির দশকে বাপি লাহিড়ীর ম্যাজিকই ছিল এমন। তবে শুধু ডিস্কো গানেই নয়, রোমান্টিক গানেও বাপি লাহিড়ীর সুরে ছিল সমান জাদু। বাংলা ছবি ‘অমরসঙ্গী’র ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ তো এখনও প্রেমের গানের তালিকায় শীর্ষে। তবে জানেন, সেই বাপি লাহিড়ীই একবার ঠিক করে ছিলেন সংগীত জগত ছেড়ে দেবেন! আর এর নেপথ্যের কারণ ছিল, কিশোরকুমার!

কিশোরকুমার সম্পর্কে মামা ছিলেন বাপি লাহিড়ীর। কিশোরকুমারও অত্যন্ত স্নেহ করতেন বাপিকে। লাহিড়ীর সুরে একের পর গান গেয়েছেন কিশোরকুমার। সে গানও আজও গানপ্রেমী মানুষদের মুখে মুখে। কিন্তু জানেন কি এই কিশোরকুমারের জন্যই বাপি লাহিড়ী ঠিক করেছিলেন সংগীতজগত ছেড়ে দেবেন। জানা যায়, কিশোরকুমারের মৃত্যুর পর একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন বাপি। আর তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনও দিনও গানে সুর দেবেন না। পরে অবশ্য সে সিদ্ধান্ত বদলেও দেন অনুরাগীদের কথা ভেবে। শুধু গানেই নয়, কিশোরকুমারের সঙ্গে একটি ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন বাপিদা।
১৯ বছর বয়সে কলকাতা থেকে মুম্বই পাড়ি দেন বাপি লাহিড়ী। বলিউডে শুরু করেন সুরের যাত্রা। ১৯৭৩ সালে ‘ননহা শিকারি’ ছবি থেকে সুরকার হিসেবে তাঁর কেরিয়ার শুরু। প্রথম থেকেই নজর কেড়ে নেন বাপি লাহিড়ী। তবে তাঁর আগে ১৯৭২ সালে বাংলা ছবি দাদুতে সুর দিয়েছিলেন লাহিড়ী। সে সময় মহম্মদ রফি ও কিশোরকুমারের মধ্যে ছিল কঠিন লড়াই। রফি ভাল, নাকি কিশোর তা নিয়ে তুমুল তরজা লেগেই থাকত অনুরাগীদের মধ্যে। এই সময়ই অসাধ্য সাধন করলেন বাপি লাহিড়ি। ‘জখমি’ ছবির জন্য একসঙ্গে বাপি ও রফিকে গানও গাওয়ালেন তিনি। যা কিনা ইতিহাস তৈরি করেছিল।

গোটা কেরিয়ারে ৫০০টি ছবিতে পাঁচ হাজারের বেশি গানে সুর দিয়েছেন বাপি লাহিড়ী। একদিনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গানের রেকর্ডিং করায় তাঁর নাম ‘গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড’ রেকর্ডেও উঠেছিল। তবে শুধু সুরকার হিসেবে নয়, বাপি লাহিড়ির স্টাইল স্টেটমেন্টও নজর কেড়েছিল সবার। সোনার গয়নার প্রতি তাঁর আলাদা ভালবাসা ছিল। নানারকম সোনার গয়না পরতেও ভালবাসেন তিনি। জানা যায়, প্রত্যেক দিনই নতুন নতুন রকমের গয়না পরতেন। তাঁর গলায় শোভা পেত আটটি সোনার চেন! যা তিনি রোজ বদলে নিতেন।

বাপি লাহিড়ীর গলায় ছিল গণেশের একটি লকেট। সেই লকেট ছিল পান্নাখচিত। বাপি লাহিড়ী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়ে ছিলেন, মাইকেল জ্যাকশন নাকি একবার তাঁর এই লকেটের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। এবং বাপি লাহিড়ির কাছে এটি চেয়েও ছিলেন!

ডিস্কো ডান্সার ছবির ‘জিমি জিমি’ গান কে না শুনেছে। এই গানটি এতটাই হিট হয় যে হলিউডের ছবিতেও ব্যবহার করা হয় বাপি লাহিড়ীর এই গান। হলিউড ছবি ‘ইউ ডোন্ট মেস উইথ দ্য জোহানস’ ছবিতে শোনা যায় ‘জিমি জিমি আজা আজা’। গায়ক, সুরকারের পাশাপাশি সমাজসেবকও ছিলেন বাপি লাহিড়ী। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জাস্টিস ফর উডোসে তাঁর অবদানের জন্য বাপি লাহিড়ীকে ‘হাউজ অফ দ্য লর্ড’ সম্মানও দেওয়া হয়েছিল।