বছর চার আগের ঘটনা মিস্টার কেরালা প্রতিযোগিতায়মহিলাদের বিভাগে যখন ২৩বছরের মাজিজিয়া ভানু মঞ্চে এসে যখন দাঁড়ালেন তখন সকলেই অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। অবাক হওয়ারই কথা, কারণ তার আগে কখনও কোনও মহিলা বডি-বিল্ডিং-এর প্রতিযোগিতায় হিজাব পরে অংশগ্রহণ করেননি। কেবল তাই নয়,মাজিজিয়া ভানু সবাইকে অবাক করে ওই প্রতিযোগিতায় বিজেতা হয়ে প্রমাণ করেন হিজাব বা বন্ধ রাখা অথবা ঢেকে রাখা কোনও মেয়ের চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
উল্লেখ্য, আরবি শব্দ ‘হিজাব’-এর অর্থ ‘ঢেকে রাখা’ বা ‘বন্ধ রাখা’। আরবি ভাষাতত্ত্ববিদ রাখিবের মতানুসারে, ‘আল-হিজাব’ হল এক ধরনের বাধা, কোনও একটি বিষয় বা বস্তুর ব্যাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করাই যার মূল উদ্দেশ্য। মুসলমান ধর্মাবলম্বী মেয়েরা যে আবরণটি পরিধান করে সেই হিজাব হল এক ধরনের মাথার আবরণ যা এক ধরনের মুখাবরণ অথবা নেকাব, যার সঙ্গে মাথার আবরণের সংযোগ থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। যে কারণে ওটির সঙ্গে দেহ আবরণীরও প্রচলন আছে।
কিন্তু সেদিন মাজিজিয়া ভানু প্রমাণ করেন হিজাব কোনও মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করার রাস্তা আটকাতে পারে না। একটি মেয়ে যদি নিজের শরীর স্বাধীন ভাবে খোলা রাখতে পারে, তবে সে স্বাধীন ভাবে নিজের শরীর ঢেকে রাখতেও পারে। তবে মাজিজিয়া ভানু দুনিয়ার একমাত্র মুসলিম মহিলা নন,হিজাব পরে আরও অনেক মহিলাই আর্ম রেসলিং এবং পাওয়ার লিফটিং করছেন।
কোরানে যে হিজাব শব্দটির উল্লেখ আছে সেকথা ঠিক। কিন্তু হিজাব শব্দটির অর্থ কি কোনও ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদের সঙ্গেই যুক্ত? বিশেষজ্ঞদের কথায়এমন কথা কোরাণের কোথাও বলা হয় নি। তার মানে এটুকু অন্তত বলাই যায় যে হিজাব ইসলাম বা মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে না। ফলে মুসলমান ধর্মে হিজাবের কোনও ধর্মীয় গুরুত্ব বা নৈতিক মর্যাদা আছে এমনটা ভাবার কোনও অবকাশ নেই। তবে কোরান নারী ও পুরুষ উভয়কেই তাদের দৃষ্টি, হাঁটা-চলা, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং যৌনাঙ্গের বিষয়ে পরিমিত ও সংযত হওয়ার উপদেশ দিয়েছে।

হিজাব নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্ক বলা ভাল আকচা আকচি তা কি আদপে হিন্দু মুসলমান বিতর্ক। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও সরকারি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন একটি বিশেষ ধর্মের পোশাক গায়ে চড়িয়ে। মাত্র কয়েকদিন আগে সরস্বতী পুজোর দিন তিনি হায়দরাবাদে স্ট্যাচু অফ ইকোয়ালিটির আবরণ উন্মুক্ত করলেন ধর্মীয় পোশাকে। তাছাড়া উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তো একটি বিশেষ ধর্মের বসন জড়িয়েই সাংবিধানিক পদে বসে সরকারি কাজ করেন।পাশাপাশি যখন যে মঞ্চে যেমনটা প্রয়োজন সেই ধর্ম অনুযায়ী টুপি-পাগড়ি-চাদর-উত্তিয় চড়ান দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে দলের নেতারা। তার মানে শুধুদলীয় রাজনীতি থেকেই নয় সরকারি কাজেও আমরা ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে দূরে রাখতে পারিনি।


উদুপির কলেজ ছাত্রীটিকে ঘিরে ধরে গেরুয়া উত্তরীয়ধারীরা যখন জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছিল তখন সেই মেয়েটি আল্লাহু আকবর ধ্বনি দেয়।নিশ্চয় মেয়েটি নিজেকে বাঁচাতে আল্লাহু আকবর আওয়াজ তুলেছিল। অনেকে প্রগতিবাদীরা এতে বিব্রত বোধ করছেন। কারণ, প্রাণ বা মান বাঁচানোর আওয়াজ যদি এই হয় তবে তো তা ঠিক ‘সেকুলার’ আওয়াজ হল না। অন্যদিকে নারীবাদীদের চিন্তা হিজাবের জন্যই যদি ছাত্রীটি শ্রীরাম ধ্বনি-র পালটা আল্লাহু আকবর ধ্বনি তুলে থাকে তাহলে কি হিজাব নারী মুক্তির প্রতীক? আর ছাত্রীটি যদি মৌলবাদের বিরোধিতা করেই আল্লহু আকবর ধ্বনি দিয়ে থাকে তাহলেও তো সে ধর্মের উপরই আশ্রয় নিল।এতে নারীরকি লাভ হল? এতসব সরল জটিল প্রশ্নে ঘোলা হচ্ছে জল।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে হিজাব না শাখা-পলা-সিঁদুর, বোর্খা না জিন্স-টি-শার্ট কী পরা হবে, তা ঠিক করবে কে? রাষ্ট্র? তাহলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার কথাটির মানে কী? কর্নাটক হাই কোর্টের রায় অনুসারে, কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ হিজাব পরে ঢুকতে পারবে না। মহান আদালতের এই রায়েও কি শেষ পর্যন্ত দেশের ধর্ম নিরপেক্ষতা রক্ষা হল নাকি একদল হিন্দুত্ববাদীদের জেহাদে মুসলিম মেয়েদের হিজাব ছাড়া করার নিদান দেওয়া হল? হিন্দুদের অধিকাংশ গৈরিক বসন না জড়ালেও শাখা-সিঁদুর পড়েন। এরপর কি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতেও সেসব না পরে আসার নিদান দেওয়া হবে? তার মানে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটির পাশে প্রশ্ন চিহ্ণ বসছে। গোড়া থেকেই হিন্দুত্ববাদীরা পোশাককে টার্গেট করেছে।স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তো বাঙালি মুসলমানের লুঙ্গিকে টার্গেট করেই ছিলেন এবার হিন্দুত্ববাদী লুম্পেনদের জেহাদে মেরুকরণ আরও তীব্র হল।
উদুপির কলেজ ছাত্রী মুসকানকে ঘিরে ধরে উত্যক্ত করা, ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়া কি কেবল পুরুষোত্তম রামের নামে জয়ধ্বনি দেওয়া না হিন্দুত্ববাদী লুম্পেন সংস্কৃতির চর্চা? হয়ত মেয়েদের প্রতি তাদের কি ধরণের দৃষ্টি-ভঙ্গি সেটাও বুঝিয়ে দেওয়া। যদি এটাই বীজ হয় তো ওরা দেশের মাটিতে সেই বীজ বপন করতে চাইছে।
4 Comments
অনেক হিন্দু ছাত্রী কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শাঁখাসিঁদুর পড়ে আসেন, আসতেই পারেন, গণতান্ত্রিক দেশ, কিন্তু হিজাব পড়ে আসা যাবে না মানেটা কি? ধর্মনিরপেক্ষ?
আসলে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটা যতক্ষণ অশ্লীল না হচ্ছে, খিস্তি না হচ্ছে ততক্ষণ হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষান্ত দেবেন না…।
হিন্দুত্ববাদীরা কি ভাবছেন বা কি করতে চাইছেন সেটা দেখা যাচ্ছে তাদের কাজে কিন্তু নারীবাদীদের ভাবনার কথাটা মনে হচ্ছে লেখক নিজের ভাবনাটাই আরোপ করেছেন।
লেখকের কথা অনুযায়ী মুসলিম মেয়েদের হিজাব পড়ার বাধ্যবাধ্যকতা নেই বা কোরানেও এমন কোনও বিধান দেওয়া নেই, যদিও এর সত্যাসত্য নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়, তদুপরি প্রশ্ন তাহলে হিজাব পরে কলেজে আসা যাবে না এই রায় নিয়েও তো ধর্মনিরপেক্ষতার কথা তোলা যায় না।
কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান বা হিজাব-শাখা সিঁদুরের কি সম্পর্ক? রাজনৈতিক দলগুলিকে যেমন ধর্ম নিয়ে ভোটের রাজনীতি করতে হয় একইভাবে ফায়দা নিতে হয় মানুষের আচার রীতি নিয়ে। এগুলিকে বন্ধ করতে হবে সাধারণ মানুষকেই। আওয়াজ তুলতে হবে নিরপেক্ষতার।