নিজেকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করলেও রাজনীতিবিদদের কাছে রেখেছিলেন। অনেক সময়ে তাত্ত্বিক রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েছেন। গান্ধিজির প্রায় প্রতিটি অনশন থেকে আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে থাকতো তাঁর নিজস্ব প্রতিবেদন, জানাতেন শুভেচ্ছা। অন্যদিকে কংগ্রেস থেকে সুভাষচন্দ্রের বহিষ্কার রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি।
১৯৩৯ সালে কংরেসের সভাপতির পদ নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয় তার সমাধান করতে রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজীকে চিঠিতে লেখেন, কংগ্রেস অধিবেশনে কিছু মানুষ জেদের বশে বাংলাকে গভীরভাবে আঘাত করেছে, তিনি যেন সেই গভীর ক্ষত উপশমের চেষ্টা করেন।
ওই বছরই কবি শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে সুভাষচন্দ্র বসুকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্র বসুকে ‘দেশনায়ক’ ও ‘নেতাজি’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। কবি সুভাষকে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ “একটি আষাঢ়ে গল্প” নামের ছোটগল্পের কাহিনি অবলম্বনে লিখেছিলেন “তাসের দেশ”, সেটি উৎসর্গ করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে। উৎসর্গ পত্রে লেখেন, “কল্যাণীয় শ্রীমান সুভাষচন্দ্র, স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক’রে তোমার নামে “তাসের দেশ” নাটিকা উৎসর্গ করলুম। শান্তিনিকেতন, মাঘ, ১৩৪৫ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”।
এই পীড়িত ও শোষিত দেশে যে একজন প্রকৃত দেশনায়কের প্রয়োজন তা রবীন্দ্রনাথ মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। আর সুভাষচন্দ্রের মধ্যে সেই সমস্ত গুণাবলী তিনি দেখতে পেয়ে বলেছিলেন, “সুভাষচন্দ্র, বাঙালি কবি আমি, বাংলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি….স্বজাতিকে বিশ্বের দৃষ্টি-সম্মুখে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে মান বাঁচাতে হবে।”
রবীন্দ্রনাথের থেকে ছত্রিশ বছরের ছোট সুভাষচন্দ্র যখন তাঁর কয়েকজন বন্ধু-সহ প্রথম শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন তখন শান্তিনিকেতন আশ্রম থাকলেও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি। সেদিন কবি মাত্র সতেরো বছরের তরুণ সুভাষকে প্রথম চোখের সামনে দেখে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, গ্রামে গ্রামে সংগঠন গড়ে মানুষের সেবা করতে।

ব্রিটিশ শাসক ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হিজলি জেলে গুলি চালিয়ে বিপ্লবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। সুভাষ মনুমেন্ট ময়দানে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ থাকা স্বত্বেও সুভাষের আহ্বানে হাজির হয়েছিলেন।
সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক কার্যকলাপ যে শুরু থেকেই রবীন্দ্রনাথকে আকর্ষণ করেছিল তা নয়, তবে সুভাষের তেজোদৃপ্ত সৌরকিরণে কবির চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। ‘দেশনায়ক’ প্রবন্ধে তিনি সেকথা স্বীকার করতে এতটুকু কুণ্ঠিত হননি। “…আজ তুমি যে আলোকে প্রকাশিত তাতে সংশয়ের আবিলতা আর নেই, মধ্যদিনে তোমার পরিচয় সুস্পষ্ট। বহু অভিজ্ঞতাকে আত্মসাৎ করেছে তোমার জীবন, কর্তব্যক্ষেত্রে তোমার যে পরিণত তার থেকে পেয়েছি তোমার প্রবল জীবনীশক্তির প্রমাণ।”
অসুস্থ সুভাষচন্দ্রকে কবি প্রেরণা ও উৎসাহ দিতে সঞ্চয়িতা’ পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন শুধু গান্ধিজি, জওহরলাল নয়, আগামী দিনে বিশ্বভারতীকে যদি সচল, সজীব করে রাখতে হয় তাহলে সুভাষচন্দ্রেরও সাহায্য প্রয়োজন। কলকাতায় শ্রীনিকেতন শিল্পভাণ্ডার-এর উদ্বোধন উপলক্ষে একথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষণে সুভাষের কাছে অকপটে লিখে পাঠিয়েছিলেন।

লন্ডনে শুয়ে বসে সুভাষচন্দ্র লিখছেন; এ খবর হাওয়ায় হাওয়ায় পৌঁছে গেল লন্ডনের দু একজন প্রকাশকের কানে। তাদের মধ্যে এডেলফির জন স্ট্রিট-এর উইশহার্ট অ্যান্ড কোম্পানি ঠিক খুঁজে খুঁজে বের করলেন সুভাষের ঠিকানা। প্রকাশক দু-চার পাতা উলটে পালটে অগ্রিম কিছু টাকা দিয়ে বায়না করে ফেললেন সুভাষের বই।
প্রকাশকের কাছ থেকে টাকা পেয়ে সুভাষচন্দ্র অনেক পাতা লিখে ফেললেন। একদিন সেই লেখা বিরাট এক বইয়ের আকার নিল। সুভাষ বইয়ের নাম দিলেন ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’। সুভাষ বইয়ের শুরুর অধ্যায়ের নামকরণ করলেন হিস্টোরিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড, তারপরের অধ্যায়ের নাম দিলেন ল্যামিং ইভেন্টস।
সুভাষের আশা তাঁর বই ইংল্যান্ড আমেরিকায় বিক্রি হবে, কদর পাবে শিক্ষিত মহলে। সুভাষের থেকেও বেশি আশা প্রকাশকের। তাই তিনি রয়্যালটির টাকা আগেই সুভাষের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। এবার বইটির জন্য চাই একটি সুন্দর ভূমিকা বা ফরোয়ার্ড। সুভাষ ভেবে ভেবে তাঁর বইয়ের ফরোয়ার্ড-এর ব্যাপারে চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথকে।

পনেরো দিন পর সুভাষ রবীন্দ্রনাথের উত্তর পেলেন। খাম খুলে চিঠিটি বের করে যখন চোখের সামনে মেলে ধরলেন, তখন তার সব উৎসাহ এক মুহুর্তে উবে গেল। সুভাষ রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর বইয়ের ভূমিকা লিখে দেওয়ার জন্য বার্নড শ ও এইচ জি ওয়েলসের সঙ্গে কথা বলতে। রবীন্দ্রনাথ সুভাষের অনুরোধ রাখেন নি।
রবীন্দ্রনাথ সুভাষকে লিখে জানিয়ে দেন, বার্নড শ-কে তিনি ভালই চেনেন তবে তিনি সুভাষের বইয়ের ভূমিকা লিখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে পারবেন না। সুভাষ এরপরও রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, তিনি তাঁর বইয়ের ভূমিকা লেখার জন্য রোমা রঁল্যা রম্যার কথা ভেবেছিলেন, তাঁর সঙ্গে সুভাষের ভালই পরিচয় হয়েছে। কিন্তু তাঁর বইয়ের ভূমিকা লেখার জন্য তিনি তাঁকে উপযুক্ত মনে করেন না। সুভাষচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে এও লিখেছিলেন যে কারণে তিনি রঁল্যাকে উপযুক্ত মনে করেননি, সেই একই কারণে তিনি রবিন্দ্রনাথকেও উপযুক্ত মনে করেন না। এরপর সুভাষ ঠিক করেন নিজের বইয়ের ভূমিকা তিনি নিজেই লিখবেন।
এর কিছুদিন পর এক দুঃসংবাদ- বাবা জানকীনাথ বসু ভিষণ অসুস্থ, সুভাষ দেশে রওনা হলেন। করাচি বিমান বন্দরে খবর পেলেন, তাঁর বাবা চলে গিয়েছেন। এরই মধ্যে ঘটল আরেক দুর্ঘটনা। পুলিশ তার জিনিষপত্র তল্লাশি করে ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ বইটির টাইপ করা কপি বাজেয়াপ্ত করল। কলকাতায় পৌঁছে সুভাষ জানতে পারলেন, সুভাষের বিরুদ্ধে ব্রিটিশের কঠোর দমননীতির প্রতিবাদে সারা দিয়েছেন সারা বিশ্বের খ্যাতনামা দিকে ব্যক্তিরা, তার মধ্যে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বার্নড শ ও এইচ জি ওয়েলসের মতো মানুষ।
1 Comment
পাঠে সমৃদ্ধ হলাম।