ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা টেস্টটিউব বেবি আজ নিঃসন্তান দম্পত্তিদের জন্য আশীর্বাদ। পৃথিবীর বহু নিঃসন্তান দম্পত্তি যে পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তানের মুখে ‘মা’, ‘বাবা’ ডাক শুনতে পান; হয়ত এখনও অজানা যে সেই সফল গবেষণা করেছিলেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী! ১৯৭৮ সালে রবার্ট এডওয়ার্ডসের গবেষণায় পৃথিবীর সর্বপ্রথম টেস্ট টিউব শিশু লুইস ব্রাউনের জন্মের ৬৭ দিন পর এদেশে জন্ম হয় পৃথিবীর দ্বিতীয় আর ভারতের প্রথম টেস্টটিউব শিশু।
যুগান্তকারী এই আবিষ্কারের খবর স্থানীয় পত্রিকার পাশাপাশি বিদেশেও প্রকাশিত হয়। কিন্তু গবেষণা নিয়ে মেতে থাকা চিকিৎসক ভাবতে পারেননি যে তিনি তাঁর সহকর্মীদের কাছে ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠবেন। যেখানে তাঁর আবিস্কারের জন্য তাঁকে মাথায় তুলে নেওয়ার কথা তার বদলে তাঁকে হেয় করার জন্য, তার কাজে বাঁধা দিতে একজন রেডিও ফিজিওলজিস্টকে প্রধান করে বাম সরকার গঠন করল এক প্রহসনের তদন্ত কমিটি! বামেদের মুখে একটিই কথা, ‘আমেরিকা যে কাজ করতে পারেনি, সে কাজ কীভাবে কলকাতায় সম্ভব হলো ?’ পদে পদে ওই চিকিৎসক বিজ্ঞানীকে অপমান, বিদেশ থেকে তাঁর আমন্ত্রণ এলে বিদেশ যাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি,তাঁর কাজে বাঁধা দিতে প্রজনন সম্পর্কিত গবেষণার তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয় একজন রেডিও ফিজিওলজিস্টকে। এছাড়াও তাঁর গবেষণায় বাধা দিতে তাঁকে বারবার বদলি করে বাম প্রশাসন।

শেষ পর্যন্ত স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে শিক্ষিকা নমিতা মুখোপাধ্যায়তাঁর স্বামীর গলায় ফাঁস দেওয়া ঝুলন্ত লাশ আবিষ্কার করলেন! সঙ্গে সুইসাইড নোট, “হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর জন্য আর অপেক্ষা করতে পারলাম না”। তাই নিজের আবিষ্কারের কারণে হাসপাতালের বাম প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজ্যের বাম সরকারের যাবতীয় অপমান গায়ে মাখতে না পেরে নিজের হাতেই নিজের জীবনের ইতি টেনে দেন। অথচ তাঁর মতো অমিত প্রতিভাধর অভিমানী বিজ্ঞানীরই নোবেল প্রাপ্য ছিল।

কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে ফিজিওলজিতে গ্রাজুয়েশন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিপ্রোডাকটিভ ফিজিওলজিতে পিএইচডি, পরবর্তীতে রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রায়োনলজিতে ইউনিভার্সিটি অব এডিনবোরো থেকে দ্বিতীয় ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে বিদেশে গবেষণা আর চাকরি ছেড়ে তিনি কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে কর্মজীবনশুরু করেন। গবেষণার টানেই প্রচলিত ডাক্তারিকরতেনই না। সামান্য সুযোগে গবেষণা বেছে নেন।
যেকোনো আবিষ্কারের বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি পাওয়ার বৈধ উপায় হল কোনো জার্নালে প্রকাশিত হওয়া। এতে পুরো কাজটি পৃথিবীর সকলকে জানানো যায় আর কাজের কৃতিত্ব চুরি যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু তার কাজটি যাতে পাবলিশ না হয় তার জন্য উঠে পড়ে লাগল স্থানীয় বাম প্রশাসন। রাজ্যের বাম সরকার কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে রাতারাতি কড়াকড়ি নিয়ম জারি করে। জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পূর্ণ তাদের খরচে ওই চিকিৎসক বিজ্ঞানীকে আমন্ত্রণ জানায় তাঁর আবিষ্কার নিয়ে কথা বলার জন্য। রাজ্যের বাম সরকার তাঁর সেখানে যাবার অনুমতি বাতিল করে দেয়।
তাঁকে হেনস্তা করতে বাম প্রশাসন বারবার এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতাল বদলি করে। তাঁর অপরাধ তিনি এক যুকান্তকারী আবিস্কারের পথে এগিয়ে চলেছেন। বারবার জায়গা বদলের ফলে তাঁর গবেষণা পুরোপুরি থেমে যায়।তাঁর আত্মহত্যার মাত্র কিছুদিন আগে তাঁকে বদলি করা হয় চক্ষু বিষয়ক এক ইনস্টিটিউটে, ইলেক্ট্রো-ফিজিওলজির প্রফেসর হিসেবে। অথচ তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি কিংবা গবেষণা দুটোই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে।
কিন্তু বাম প্রশাসকদের শয়তানি বদমায়শি ধরা পরে যায় বিজ্ঞানী টি. সি. আনন্দ কুমারের হাতে। তাঁর গবেষণাতে দেশে জন্ম নেয় আরেক টেস্ট টিউব শিশু হর্ষবর্ধন রেডি। ফলে তিনিই ভারতের প্রথম টেস্টটিউব শিশু নিয়ে সফলতার স্বীকৃতি পান। কিন্তু এই সবকিছু উল্টে যায় আনন্দ কুমার কলকাতায় এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে এলে। তাঁর হাতে আসে ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার বিভিন্ন ডকুমেন্ট। সেই ডকুমেন্ট আর দুর্গার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আনন্দ কুমার বুঝতে পারেন ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই ভারতে টেস্ট টিউব শিশু নিয়ে গবেষণার প্রথম সফল ব্যক্তি।

অবহেলা, অপমান এবং আত্মহত্যার পর আলোর মুখ দেখল ডাঃ ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা। আনন্দ কুমারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই সুভাষ মুখোপাধ্যায় মৃত্যুর পর ভারতের প্রথম সফল টেস্টটিউব শিশুর গবেষক হিসেবে স্বীকৃতি পান। বাম শাসক ও প্রশাসকরা বহু চেষ্টা করে করেছিল কিন্তু আনন্দ কুমার নিজের মাথা থেকে সাফল্যের মুকুটটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে দিতে দ্বিধা করেননি। বামেদের চামড়া কতটা পুরু তা জানতেন না বলেই আনন্দ কুমার তৎকালীন রাজ্যের শাসক ও স্বাস্থ্য প্রশাসকদের নিচ ও হীন ভূমিকার তীব্র নিন্দা করেছিলেন। তাঁর ভাষায়,ডক্টর সুভাষকে অবশ্যই ভারতে প্রথম সফল টেস্টটিউব শিশু আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিতে হবে। ১৬ জানুয়ারি ডাঃ সুভাষের ৯১তম জন্মদিন।
1 Comment
বাম জমানায় এমন বহু অপমৃত্যু ঘটেছে- শিল্পে সাহিত্যে বিজ্ঞানে যা কিন্তু থেমে নেই। শাসক সে বাম হোক আর ডান ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ফ্যাসিবাদকেই বর্ম করে।