বিগত শতকের সাতের দশকে ভারতীয় ক্রিকেটে জোরে বল করতেন আবিদ আলি, একনাথ সোলকার প্রমুখ। একসময় সুনীল গাভাসকার, অজিতওয়াদেকর, বুধি কুন্দরনরাও বেশ কয়েক পা দৌড়ে আসতেন। কিন্তু বোলার হিসাবে এঁরা বল হাতে পেতেন বড়জোর দু-তিন ওভার। তারপর স্পিনাররাই হাত ঘোরাতেন।সাতের দশকের মাঝামাঝি সময় ভারতের হয়ে ইনিংস শুরু করেতেন কারসন ঘাউড়ী ও মদনলাল। ব্যাটসম্যানের কাছে তাদের বল আসত মোটামুটি জোরে।তবে তখনও ভারত জিতলে সেই জয় হত স্পিনারদের কারণেই।
এর বেশ কয়েক বছর পর পাকিস্তানের মাটিতে ভারতের টেস্ট সিরিজ। কিন্তু ভারত ২-০ তেহারে। তবে ওই সফরে ভারত পেয়ে যায় ক্রিকেটারের মতো চেহারার একটি ছেলেকে। পাকিস্তান সফরের সেই দুর্দিনেও ছেলেটি ৩৩ বলে ৫০ রানের একটি সাহসী ইনিংস খেলেছিল। তখনও বোঝা যায় না পরবর্তী দেড় দশক ওঁর কাঁধে ভর দিয়েই ভারতীয় ক্রিকেট প্রথম খুব জোরে দৌড়বে।বিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা ভারতের পেস বলে বিভ্রান্ত হবেন।

এরপর ১৯৭৯-র শেষে পাকিস্তান এল।ভারতের ব্যাটিং লাইন খুব ভাল ছিল কিন্তু স্পিনের সেই দিন নেই। মনসুর আলি খান পতৌদি নিরাশ হয়ে মন্তব্য করে ফেলেছিলেন,‘মনে হয় না, ভারতের পক্ষে পাকিস্তানের ২০ জনকে আউট করা সম্ভব হবে’।কিন্তু ভারত ২-০ সিরিজ জিতল। আর সেটা হল ওই ছেলেটির জন্যই। পাক-অধিনায়ক আসিফ ইকবাল বলেছিলেন,‘দুটো দলের মধ্যে তফাৎ একটাই– কপিলদেব’।
ওই বছর ভাঙাচোরা একটি দল নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এসেছিল। ভারত চেন্নাইতে এ্কটি মাত্র টেস্ট জিতেছিল।ওয়েস্ট ইন্ডিজের১২৫ রান তাড়া করতে নেমে ভারতের ৮৪ রানে যখন ৬ উইকেট তখন ওই ছেলেটি জ্বর গায়ে ব্যাট হাতে নামলেন আর পরপর তিনটে বাউন্ডারি মারলেন। ক্রিজে অপরাজিত থেকে ভারতকে তিন উইকেটে জয় এনে দিলেন। সেদিনের পর পতৌদি বলেই ফেললেন, ‘আমার টিমে একটা কপিলদেব ছিলনা।

১৯৮৩-র বিশ্বকাপে ভারতীয় দল নিয়ে কারোরই কোনও আশাছিল না। থাকার কথাও নয়। আগের দুবার ছ’ম্যাচ খেলে ভারত ১টি ম্যাচ জিতেছিল পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গে। যাই হোক সেবার ২৪ বছর বয়সী ছেলেটি অধিনায়ক। তবে সেই নতুন অধিনায়কের নেতৃত্বে প্রথম ম্যাচে আগের দু’বারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারায় ভারত। পরের ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে হারালেও অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারে ১৬২ রানে। সেই ম্যাচে অধিনায়ক ছেলেটি ৪৩ রানে ৫ উইকেট নেয়। পরের ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারলে পরিস্থিতি দাঁড়ায় শেষ দুই ম্যাচে জিম্বাবুয়ে আর অস্ট্রেলিয়াকে হারাতেই হবে।
জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ম্যাচে দ্বিতীয় বলেই শূন্য রানে আউট গাভাস্কার। দলের ৬ রানের মাথায় শ্রীকান্তআউটশূন্য রানে। ৯ রানে আরও দু’জন ব্যাটসম্যান আউট হলে ব্যাট হাতে মাঠে নামেন অধিনায়ক। দল তখন ১৭ রানেপাঁচ উইকেট।তরুণ অধিনায়ক রজার বিনি আর মদন লালকে নিয়ে গড়লেন ৬০ আর ৬২ রানের দুটো জুটি। ১৪০ রানে ৮ নং ব্যাটসম্যান মদন লাল আউট হলেন, সেখান থেকে অধিনায়ক ছেলেটির ১৩৮ বলে ১৭৫ রানের ইনিংসের কল্যাণে ৬০ ওভার শেষে ভারত দাঁড় করাতে পারলো ২৬৬ রান। অধিনায়কের সেঞ্চুরিতেই পুরো দল উজ্জীবিত হল।

ফাইনালে ভারত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে মাত্র ১৮৩। কিন্তু অনেকখানি দৌড়ে অসাধারণ দক্ষতায় ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচ তালুবন্দি করে ফের দলকে উদ্দীপ্ত করলেন সেই অধিনায়ক। প্রথম এশীয় অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ জিতলেন কপিল দেব।
শুধু কি তাঁর ব্যাটিং বা বোলিং নয়, অধিনায়ক কপিল ভারতকে বিশ্বক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত করেছিল আগের সব ধ্যান-ধারণা ঝেরে ফেলে। কপিলের নেতৃত্বেই ১৯৮৬ সালে ভারত ইংল্যান্ডের মাঠে ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জেতে। এছাড়া ১৯৮০-৮১-তে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে তার ২৮ রানে ৫ উইকেট; অস্ট্রেলিয়া মাত্র ৮৩ রানে অলআউট হয় এবং ভারত সিরিজ ড্র করতে সমর্থ হয়। সেটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ভারতের প্রথম কোনো সিরিজ ড্র করতে পারা। এরপরঅস্ট্রেলিয়ার মাঠে ভারতের টেস্ট সিরিজ জিততে অনেক ঘাম ঝড়াতে হয়েছে।

কপিল দেব টেস্ট ইতিহাসে তখন একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি একইসঙ্গে ব্যাটিংয়ে ৪,০০০ রান আর বোলিংয়ে ৪০০ উইকেট শিকারি। তিনিই একমাত্র অধিনায়ক, যিনি এক ইনিংসে ৯ উইকেট নিয়েছেন।
এই দেশ বহু প্রতিভাবান স্পিনার এবং ব্যাটসম্যান উপহার দিলেও ফাস্ট বোলিংয়ে একেবারেই অনুর্বর ছিল। কপিল দেবই প্রথম ভারতীয়দের মনে বিশ্বাস জন্মান যে, ভারতেও ফাস্ট বোলার হওয়া সম্ভব। ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময়ই ভারতের পেস আক্রমণকে নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছেন। উপমহাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে ছুঁয়েছেন ৪০০ উইকেটের মাইলফলক।
একজন খেলোয়াড়কে শুধু মাঠেনয়, তাকে লড়াই করতে হয় ফিটনেস ঠিক রাখার ক্ষেত্রেও। ১৬ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে ইনজুরির কারণে কখনোই কোনও টেস্ট ম্যাচ মিস করেননি কপিল। ১৮৩ ইনিংসের টেস্ট ক্যারিয়ারে কখনোই রান আউট হননি কপিল।
2 Comments
ভারতীয় ক্রিকেটে কত বিরাট, লম্বা, চওড়া-রা এসেছেন গিয়েছেন কিন্তু একজনই মাত্র কপিলদেব এসেছেন, যাকে ভর করে জোরে বল করা, মাটি কামড়ে ফিল্ডিং করা, বাউন্ডারির
বাইরে বল পাঠানো এসব এসেছে। ভারত অন্য ক্রিকেট খেলতে শিখেছে, বুঝিতে শিখেছে…
যতক্ষণ মাঠে ততক্ষণ পাগলের মতো ব্যাটিং, বোলিং অথবা ফিল্ডিং করে যাওয়া, লক্ষ্য দেশের জয়- এরই নাম কপিলদেব