তখন লেখকের বয়স ৪৪। ১৩৭৪ সালে শারদীয় দেশ-এ প্রকাশিত লেখকের উপন্যাসটিকে অশ্লীল দাগিয়ে তরুণ অ্যাডভোকেট অমল মিত্র নিষিদ্ধ করার আবেদন করে ১৯৬৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মামলা করলেন। সেই দায় লেখক বয়ে বেড়ান আরও ১৭ বছর।
আবেদনকারীর পক্ষে যে ৮ জন সাক্ষী দেন, তার মধ্যে ৭ম সাক্ষী হিসেবে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্যের নাম ছিল। অবশ্য দুইজনের কেউই তাঁর পক্ষে সাক্ষী দিতে আসেননি। সমরেশ বসু ছাড়াও আসামি হিসেবে ছিলেন দেশ-এর প্রকাশক ও মুদ্রাকর সীতাংশুকুমার দাশগুপ্ত। লেখকের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, নরেশ গুহ প্রমুখ।
কলকাতা চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বাদীপক্ষের অভিযোগের ও সাক্ষ্যের সারকথা ছিল, ‘প্রজাপতি’ অশ্লীল,সাহিত্যের পবিত্রতা নষ্টকারী এবং প্রজাপতি পড়ার পর কিশোর-কিশোরীরা উচ্ছন্নে যেতে বসেছে। যুবকেরা যৌনতায় ভরপুর এই উপন্যাস পড়ে চরিত্র হারাচ্ছে। এর আগে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা লাইন দিয়ে দেশ-এর ওই শারদীয় সংখ্যাটি কিনেছে। ‘প্রজাপতি’-র মধ্যে কোনও সামাজিক ও নৈতিক সাহিত্যমূল্য নেই।

বুদ্ধদেব বসু বললেন অন্য কথা,এই উপন্যাসে তিনি এই বঙ্গের সামাজিক বাস্তবতার ছবিই পেয়েছেন। এর ভেতরে অশ্লীল বলে কোনো কিছুই তাঁর মনে হয়নি। আর সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীলতার নিক্তি কোথায়? তাহলে রামায়ণ-মহাভারতের মতো মহাগ্রন্থের বিরুদ্ধেও অশ্লীলতার অভিযোগ উঠবে। এই উপন্যাসের নায়ক ও প্রায় প্রত্যেকটি নারী-পুরুষ এবং তাদের কাজকর্মে যা কিছু নষ্টামি বলে মনে হয় তা আসলে সময়েরই ছবি। এবং সেই ছবি বাস্তবসম্মত। ‘প্রজাপতি’-র লেখক সমাজের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়েছেন।
নরেশ গুহ বলেন, ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসের অনেক শব্দ বা কথা আগে কখনো ব্যবহার হয়নি। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথও অনেক শব্দ ব্যবহার করছেন, যা তাঁর আগে কেউ কখনো ব্যবহার করেননি। সমরেশ বসু তার লিখিত বিবৃতিতে এই উপন্যাসের গঠন, চরিত্র চিত্রণ এবং তার নায়ক সুখেনের জীবন ও তাঁর কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বাবার দুর্নীতি, দাদাদের দলীয় রাজনীতিকে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার করা সব সুখেনের মনকে তিক্ত করে তোলে। সে বেখাপ্পা হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে অবাধ্য। উপন্যাসটি তাঁর জীবনের শেষ চব্বিশ ঘণ্টার কাহিনী। তার মতে, কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক লোক সুখেনের মতো মাস্তান চরিত্র দিয়ে প্রভাবিত হতে পারে না। বরং যাদের বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তারা সাবধান হবেন।
অবশ্য ‘প্রজাপতি’ নিষিদ্ধ করার মামলার রায় বাদীর পক্ষেই যায়। ১১ ডিসেম্বর, ১৯৬৮ সালে রায় ঘোষণা করা হয়: উপন্যাসটি অশ্লীল এবং একে নিষিদ্ধ করতে হবে। আশ্চর্যের বিষয়; দিনটি ছিল সমরেশ বসুর জন্মদিন। রায়ে বলা হয়, উপন্যাসটিকে অশ্লীল বলে ঘোষণা করার পর তার লেখক সমরেশ বসুকে কোনও মতেই অব্যাহতি দেওয়া যায় না। তা তিনি যত বড় লেখকই হোন না কেন?এই মন্তব্যসহ আমি তাঁর আলোচ্য উপন্যাস ‘প্রজাপতি’-কে অশ্লীল ঘোষণা করছি। তাকে সাজাও দিচ্ছি। ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯২ ধারা অনুযায়ী তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করছি। ২০১ টাকা জরিমানা অনাদায়ে দু’মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিচ্ছি। এবং প্রকাশককেও একই সাজা দেওয়া হয়। এবং দেশ শারদীয় সংখ্যা(১৩৭৪)-এর ১৭৪ থেকে ২২৬ পৃষ্ঠা নষ্ট করে দেওয়ার জন্য বলা হয়।

রায়ের প্রেক্ষিতে জরিমানার টাকা জমা হয় এবং মামলা হাইকোর্টে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কলকাতা হাইকোর্টও ব্যাঙ্কসাল কোর্টের রায় বহাল রাখে। ১৯৭৩ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি মামলাটিকে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার অনুমতিও নাকচ করে দেন। কিন্তু হাল ছাড়েন না সমরেশ বসু ও দেশ কর্তৃপক্ষ। মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে ওঠে ১৯৭৯ সালে। ১৯৮০ সালে প্রজাপতির অনুবাদ চাওয়া হয়। অনুবাদ ১৯৮২ সালে জমা হলেওতা দুর্ভাগ্যজনকভাবে আগুনে পুড়ে যায়। ১৯৮৫ সালে ফের অনুবাদ পেশ করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২০, ২২ ও ২৩ আগস্ট শুনানি চলে। রায় প্রকাশিত হয় এক মাস পর ১৯৮৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, প্রজাপতি অশ্লীল নয়, অভিযুক্তদের অভিযোগমুক্ত করা হল। সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি ১২ বছর ধরে চলেছিল। রায় ঘোষণা হলে সাগরময় ঘোষ গোটা ঘটনাটিকে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করেন। বাংলা সাহিত্যের কোনও উপন্যাস নিয়ে ১৭ বছর ধরে আইনি লড়াই সেই প্রথম এবং একমাত্র।
সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ ঘিরে একসময় আলোচনার অন্ত ছিল না। অথচ উপন্যাস এবং নায়ক সুখেন যার জবানে আখ্যানটি আমরা পড়ি সে বয়ান মাত্র ২৪ ঘণ্টার। যদিও সেখান থেকেই উঠে আসে সুখেনের গোটা জীবন। বয়ানের সূচনা একটা প্রজাপতি ধরার কাহিনী তারপর নানা ঘটনা, আসে জিনা নামে একটা মেয়ের কথা, তার সঙ্গে শিখার কথা। শিখাকে সুখেন বিয়ে করে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল। সে হতে চেয়েছিল শিক্ষক। দুর্নীতিপরায়ণ বাবা, বেল্লেলাপনার হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া মা, বড় দুই ভাইয়ের রাজনীতি ও স্বার্থসিদ্ধিসহ নানা পাঁকচক্রে পড়ে সুখেনের আর কিছু করা হয় না। বেঁচে থাকার উপায় শেষ পর্যন্ত মাস্তানি। কায়েমি স্বার্থবাদী লোকজন, সমাজের তথাকথিত অভিজাতরা তাকে ব্যবহার করে। সেও সুযোগ নেয় ভোগ-বিলাসের। একটি দুর্ঘটনায় কাহিনীর ইতিপড়ে।
নারী শরীরের বর্ণনা আছে ঠিকই কিন্তু নারী-পুরুষের শরীরের তুমুল কোনও দৃশ্যের বর্ণনা তো নেই। যেটুকু আছে তা আভাসে ইঙ্গিতে। প্রজাপতি উপন্যাসের বেশ কিছু শব্দ সেই সময়কার কলকাতার রাস্তাঘাটের কথাবার্তা থেকে উঠে এসেছে। আসলে লেখক সমরেশ যে লম্পট ও বখে যাওয়া ব্যক্তির জবানে তাঁর নিজের কাহিনী তুলে আনতে চাইলেন সেই ভাষায় ওঁই সব শব্দ খুবই মানানসই। প্রজাপতি লেখকের শ্রেষ্ঠ লেখা নয়, পাঁচটি অতি মূল্যবান উপন্যাসেরও একটি নয়। আবার অশ্লীলও নয়। বরং এটাই মনে হয়, না জেনে বুঝেই ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটির গায়ে অশ্লীল লেবেল সেঁটে দিয়ে তাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করা হয়েছে, জনপ্রিয়তা বাড়ানো হয়েছে।
3 Comments
জানা ঘটনা তবু পড়তে চমৎকার লাগলো।
এত তথ্য জানা ছিল না, সমৃদ্ধ হলাম।
এই লেখাটির লেখক সমরেশ বসুর প্রজাপতি উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষনার ইতিহাস তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সুন্দরভাবে।