কলকাতা ব্যুরো: ভয়াবহ হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা কেড়ে নিলো সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের অন্যতম নায়ককে। প্রয়াত দেশের প্রথম সেনা সর্বাধিনায়ক বিপিন রাওয়াত। ৮ ডিসেম্বর, বুধবার দুপুরে তামিলনাড়ু-কর্ণাটক সীমানায় নীলগিরি পাহাড়ের কাছে ভেঙে পড়লো রাওয়াতের চপার। তাঁর সঙ্গেই অভিশপ্ত ওই এমআই-১৭ হেলিকপ্টারে ছিলেন তাঁর স্ত্রী মধুলিকা। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন তিনিও। চপারে থাকা ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জনেরই মৃত্যু হয় দুর্ঘটনায়। এখনও চিকিৎসাধীন গ্রুপ ক্যাপ্টেন বরুণ সিং।
১৬ মার্চ ১৯৫৮, উত্তরাখণ্ডের পাউরিতে যোদ্ধা পরিবারে জন্ম হয় বিপিন রাওয়াতের। দেরাদুন ও শিমলায় স্কুলশিক্ষা শেষে যোগ দিয়েছিলেন ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে। ১৯৭৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর গোর্খা রেজিমেন্ট থেকে সেনায় শুরু হয় তাঁর কেরিয়ার। তারপর সময়ের সঙ্গে কাশ্মীর-সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ফৌজি ইউনিটের দায়িত্ব সামলেছেন। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রসংঘের হয়ে কঙ্গোতে শান্তিরক্ষা অভিযানেও অংশ নেন তিনি।

সাহসিকতা ও কর্তব্যে অবিচল থাকার জন্য তাঁর ইউনিফর্মে যুক্ত হয়েছে পরম বিশিষ্ট সেবা মেডেল, বিশিষ্ট সেবা মেডেল, সেনা মেডেল, অতি বিশিষ্ট সেবা মেডেল, যুদ্ধ সেবা মেডেল এবং উত্তম যুদ্ধ সেবা মেডেল। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেশের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন জেনারেল বিপিন রাওয়াত। দীর্ঘ দিনের সেনা জীবনে বর্ণময় অধ্যায় জড়িয়ে রয়েছে প্রতিরক্ষা প্রধানের। ২০১৯ সালে অবসরের পর দেশের প্রথম সেনা সর্বাধিনায়ক পদে নিয়োগ করা হয় তাঁকে।
তবে তাঁর মুকুটের সেরা পালক হচ্ছে ২০১৫ সালে মায়ানমারে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। তাঁর নেতৃত্বেই মায়ানমারে ঢুকে নাগা জঙ্গিগোষ্ঠী এনএসসিএন (খাপলাং)-এর শিবিরে হামলা চালায় ভারতের বিশেষ কমান্ডো বাহিনী।

মেজর পদে থাকাকালীন জম্মু ও কাশ্মীরের উরিতে সেনার এক কোম্পানির নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে কর্নেল পদে, কিবিথুতে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর পূর্ব সেক্টরে ১১ গোর্খা রাইফেলসের পঞ্চম ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। নিজের কর্মদক্ষতা এবং দেশের প্রতি ভালবাসায় ক্রমেই সেনার উচ্চ পদে উঠে আসেন তিনি। ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পদোন্নতির পর তিনি সোপোরে রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের পঞ্চম সেক্টরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ‘চ্যাপ্টার সেভেন মিশনে’ এক বহুজাতিক ব্রিগেডের দায়িত্ব সামলানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে বিপিন রাওয়াতের। সেই দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি দুই বার ফোর্স কমান্ডারের সম্মানে ভূষিত হন।
মেজর জেনারেল পদে আসার পর, রাওয়াত উরিতে ১৯তম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং হিসেবে দায়িত্ব নেন। পরবর্তী সময়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসাবে, তিনি পুনেতে সাউদার্ন বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মাঝে ডিমাপুরে সেনার সদর দফতর তৃতীয় কর্পস কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি সেনা কমান্ডার পদে আসার পর সাউদার্ন কমান্ডের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সেই পদে অবশ্য খুব বেশিদিন ছিলেন না রাওয়াত। দ্রুত তাঁকে আরও বেশি দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিরক্ষায়। ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভাইস চিফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব নেন। আড়াই মাস সেই পদে থাকার পর আরও গুরু দায়িত্ব। ওই বছরেরই ১৭ ডিসেম্বর চিফ অব আর্মি স্টাফ পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

নিজের কর্মদক্ষতা ও উত্তর-পূর্ব ভারতে জঙ্গি কার্যকলাপ সম্পর্কে রাওয়াতের জ্ঞানের পরিধি ছিল অসীম। নাগাল্যান্ডের ছোট্ট পাহাড়ঘেরা শহর ডিমাপুরে সেনার থার্ড কোরের দায়িত্ব ছিল রাওয়াতেরই কাঁধে। সেনার বিশেষ কমান্ডো বাহিনী ২১ প্যারা স্পেশ্যাল ফোর্স-এর রাশ ছিল তাঁর হাতে। সেই কারণে মণিপুরে জঙ্গি হামলার পর নাগা জঙ্গিদের পাল্টা মার দিতে রাওয়াতের উপরই ভরসা রাখেন তৎকালীন সেনাপ্রধান দলবীর সিং সুহাগ।

দিল্লির সবুজ সংকেত মিলতেই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রস্তুতি শুরু হয় রাওয়াতের। ৯ জুন, ২০১৫ সালে মণিপুরের উখরুল হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে মায়ানমারের শত্রু এলাকায় প্রবেশ করে ৭০ জনের ভারতীয় কমান্ডো বাহিনী। সেদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এনএসসিএন-এর শিবিরে হামলা শুরু করে কমান্ডো বাহিনী। শহিদ জওয়ানদের বদলা নিয়ে ওই হানায় খতম করা হয় কমপক্ষে ৩৮ জন জঙ্গিকে।

খাপলাং গোষ্ঠী বুঝতে পারে এবার সীমান্ত পেরিয়ে হামলা চালাতে পিছপা হবে না ভারতীয় বাহিনী। সেই হামলার পরই শিরোনামে উঠে আসে সাহসিকতার জন্য একের পর এক পদকজয়ী বিপিন রাওয়াতের নাম। এহেন সাহসী যোদ্ধা ও সেনানায়কের অকাল প্রস্থানে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।