পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বড় বিশ্বাসঘাতক কে? একটি নাম উঠলেও বেশির ভাগই বলবেন মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস। কেবল উইলিয়াম শেকসপিয়র কেন আরও অনেকের লেখাতেই উঠে এসেছে তার নাম। এট টু, ব্রুটে?নাট্য-সাহিত্যের ইতিহাসে জনপ্রিয়এই সংলাপটি এসেছিল উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের হাত ধরে। ১৫৯৯ সালে লেখা তাঁর 'জুলিয়াস সিজার' নাটকের তৃতীয় অংকের প্রথম দৃশ্যে যখনএকের পর এক ছুরির আঘাতে রোমের স্বৈরশাসক জুলিয়াস সিজারকেখুন করা হচ্ছিল তখন সিজার তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও শিষ্য মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাসকেও তাঁর হত্যা ষড়যন্ত্রে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে এই শব্দ তিনটি বলেছিলেন। তবে 'জুলিয়াস সিজার' নাটকেই যে প্রথম এই সংলাপটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা নয়। তার আগেও সংলাপটি অন্তত দুটি এলিজাবেথিয়ান নাটকে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৫৮২ সালে রিচার্ড ঈডস রচিত 'সিজার ইন্টারফেকটাস' নাটকেএবং ১৫৯৫ সালে শেক্সপিয়ারের'ষষ্ঠ হেনরি, তৃতীয় পর্ব' তে এই সংলাপটি ছিল। তবে এ কথা ঠিক যে 'জুলিয়াস সিজার' নাটকেই সংলাপটি জনপ্রিয় হয়।

প্রসঙ্গত, শেক্সপিয়ারের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের প্রেরণা প্রাচীন রোমের ইতিহাসবিদ প্লুটার্কের লেখা ‘লাইভস’। এই বইটির তিনটি চরিত্র সিজার, ব্রুটাস ও মার্ক অ্যান্টনির উপর ভিত্তি করে তিনি নাটকটি ভেবেছিলেন। তবে সিজার এমন কোনও কথা বলেছিলেন কিনা, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রোমান ইতিহাসবিদ সুয়েটোনিয়াস জানান, মৃত্যুর সময় সিজার কিছুই বলেননি। অন্যদিকে প্লুটার্ক বলেন,সিজার হত্যাকারীদের দলে ব্রুটাসকে দেখতে পেয়ে রোমের ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় লম্বা পোশাক ‘টোগা’র আড়ালে মুখ লুকিয়ে স্বগতোক্তি করেন, “হায় ব্রুটাস,তুমিও!”

খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দে পম্পিদের পরাজিত করে জুলিয়াস সিজার রোমে পৌঁছালে তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। এতে সিনেটের অনেকের মনেই ভয় ঢোকে যে, সিজার বুঝি তাদের সবাইকে তাড়িয়ে রোমের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠবে।হিংসা আর ক্রোধ শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রে পরিণত হয়। তাছাড়া সিজারকে তারা রোমের সম্রাট ভাবতে পারেনি, তারা চেয়েছিল রোম হবে প্রজাতন্ত্র। ক্যাসিয়াস সিজারের শত্রু পম্পির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিজারকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে, দলে টানে সিজারের ঘনিষ্ট বন্ধু ব্রুটাসকে।
সাইপ্রাসে সরকারি চাকরির পাশাপাশি সুদের ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী বনে যাওয়া ব্রুটাস রোমে ফিরে জুলিয়াস সিজারের পক্ষে সিনেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। তবে রোমে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ব্রুটাস জুলিয়াস সিজারের শত্রু পম্পের পক্ষে অস্ত্র ধরেন। সিজার এ জন্য তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েও কোনো ধরনের সন্ত্রাস বা যুদ্ধ না করার শর্তে রেহাই দেন।সিজার গৃহযুদ্ধে জয়ী হলে ব্রুটাস ক্ষমা চেয়ে সিজারকে চিঠি লেখেন। সিজার তাকে ক্ষমা করে একান্ত আস্থাভাজন মনে করেন। পরবর্তীতে একটি গ্রাম এবং একটি শহরের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। আফ্রিকা জয়ের পর রোমে সিজারের প্রভাব ও প্রতিপত্তি আরও বৃদ্ধি পেলে সিনেটররা আরও ক্ষেপে গিয়ে সিজারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ব্রুটাস সিজারের অনুগ্রহের কথা ভুলে সিনেটরদের পক্ষে যোগ দেয়।

সিজার কিন্তু মনে করতেন তাঁর পর রোম শাসন করার ক্ষমতা একমাত্র ব্রুটাসের আছে। ব্রুটাস নিজের ক্ষমতায় তা অর্জন করবে এবং এজন্য সে কখনও নিচ বা অকৃতজ্ঞ হবে না।সিজারের এই ধারণা পরবর্তীতে মিথ্যে প্রমাণিত হয়।মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস যে একদিন ছিল রোমান রিপাবলিক জেনারেল জুলিয়াস সিজারের সহযোদ্ধা, সেই পরবর্তীতে হয় সিজারের খুনের অন্যতম পরিকল্পনাকারী। খুন হলেন সিজার আর তারপরেই নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় রোমান রিপাবলিকে।সিজারের বিশ্বস্ত অনুগত জেনারেল মার্ক এন্টনি ও জেনারেল অগাস্টাসের বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় সিনেট সমর্থিত ব্রুটাস ও ফিলিপিতে ক্যাসিয়াস পরাজিত হয় ও আত্নহত্যা করে।এর কিছুদিন পরে একই জায়গায় অগাস্টাসের মুখোমুখি হয় ব্রুটাস। দ্বিতীয় যুদ্ধে অগাস্টাসের বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে ব্রুটাস আত্নহত্যা করে।

রোমের অনেক ঐতিহাসিক বলেন, ব্রুটাস সিজারকে হত্যা করতে চায়নি, তাকে বোঝানো হয়েছিল সিজার সম্রাট হয়ে রোমের প্রজাতন্ত্রকে চিরতরে ধ্বংস করে ফেলবে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্যাসিয়াসের ষড়যন্ত্রে একপর্যায়ে ব্রুটাস শামিল হয়।অনেক ইতিহাসবিদের ধারণা, ব্রুটাসের মায়ের সঙ্গে সিজারের সম্পর্ক ছিল। যে কোনও ছেলেই তা সহজভাবে মেনে নেয় না।পুরনো রাগ মেটাতেই ব্রুটাস সিজার হত্যার ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিল।
3 Comments
একটি অনবদ্য পাঠের অভিঙ্গতা হল। এখানে ইতিহাস-দর্শন-সাহিত্য মিলেমিশে একাকার হলেও তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব সজাগ।
প্রাচীন রোমের ইতিহাসের এই চরিত্রটি প্রায় সকলেরই চেনা। জুলিয়াস সিজার ও ব্রুটাস তো প্রবাদ হয়ে আছেন। কিন্তু ঘটনাবহুল সেই বিস্তারিত ইতিহাস জেনে ফেলা গেল এক
নিঃশ্বাসের পাঠে।
ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে বিরাট সাম্রাজ্যের পতন আর সেই সেই সাম্রাজ্যের সম্রাটকে শেষ হতে হয়েছে বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রে, যে একদা ছিলেন সম্রাটের সবথেকে বিশ্বাসী
লোক।