কলকাতা ব্যুরো: সভ্যতা যত এগিয়েছে বিজ্ঞানও মানু্ষকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে, দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর সেই সমস্ত উপহার জীবনযাপনকে সহজ থেকে আরও সহজতর করে তুলেছে ৷ কিন্তু বিজ্ঞানের সেই আশীর্বাদ মানুষের বিবেচনার অভাবে পরিণত হয়েছে অভিশাপে ৷ প্লাস্টিক বর্জ্য তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ৷ আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্লাস্টিকের ব্যবহার আজ অপরিহার্য ৷ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিকল্প সামগ্রী হিসেবে পলিমারের ব্যবহার হচ্ছে ৷ ক্যারি ব্যাগ থেকে ওষুধের বোতল, খাদ্য পরিবেশনের পাত্র থেকে ফুলেব টব- বিভিন্ন ক্ষেত্রে চটের ব্যাগ হোক কিংবা কাঁচের শিশি; সব কিছুরই বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক ৷ অপেক্ষাকৃত সস্তা, বহনযোগ্য হওয়ার কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছ পলিমারে তৈরি সামগ্রী ৷ এর ব্যবহার নিয়ে আশা করি কারও আপত্তি নেই, কিন্তু ব্যবহারের পর যেভাবে এগুলিকে যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে, আপত্তি সেখানেই ৷
সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় তারা ব্যবহার করা প্লাস্টিকের সামগ্রী যেখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছে ৷ যেহেতু প্লাস্টিকের সামগ্রী মাটিতে মিশে যায় না, এর একাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়, তাই ক্রমশ তা বর্জ্য হিসেবে জমা হচ্ছে লোকালয়ের বুকে ৷ আর তা থেকেই ছড়াচ্ছে দূষণ ৷ পলিমার সামগ্রী পুড়িয়ে ফেললে আরও বিপদ, হাইড্রোকার্বন হয়ে বাতাসে মিশে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে দূষণের মাত্রা ৷

তবে এবার চিন্তা অনেকটাই কমিয়ে দিলেন বেহালা আর্য বিদ্যামন্দির এবং নিউ আলিপুর কলেজের ছাত্র সুদীপ্ত বসু। আলুর স্টার্চ থেকে তৈরি এক ধরনের ক্যারি ব্যাগ বাংলার বাজারে এনেছেন বঙ্গতনয় সুদীপ্ত। ফুটন্ত গরম জলে ফেললে নিমেষেই দ্রবীভূত হয়ে যায় এই ক্যারিব্যাগ। ২০১৯ সালে গুয়াহাটি আইআইটির উদ্যোগে উদ্ভিজ ষ্টার্চ অর্থাৎ আলু, ভুট্টা, সাবু দানা প্রভৃতি থেকে প্রাপ্ত শ্বেতসার দিয়ে পরিবেশবান্ধব ক্যারি ব্যাগ তৈরি হয়। এভাবেই বায়ো ডিগ্ৰেডেবল প্লাষ্টিকের পথ চলা শুরু।
বৈজ্ঞানিকদের দাবি, ষ্টার্চ থেকে তৈরি পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক সম্পূর্ণভাবে বায়ো ডিগ্রেডেবল। যা পরিবেশের জন্য খুবই উপকারী ও অধিক টেকসই। এই ব্যাগ প্লাস্টিকের কোন পলিমার ছাড়াই তৈরি করা হয়। আর দেখতে হুবহু প্লাস্টিকের মতো হলেও তা পরিবেশে মিলিয়ে যায় মাত্র ১৮০ দিনের মধ্যে। ব্যবহারের পর মাটিতে ফেলে দিলে, মাটির কোন ক্ষতি তো করেই না বরং মাটির সাথে অতি দ্রুত মিশে গিয়ে মাটির গুনগত মান বৃদ্ধি করে ফসল উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।

বেহালা আর্য বিদ্যামন্দির এবং নিউ আলিপুর কলেজের ছাত্র সুদীপ্ত বসু দিল্লীর আইইটিই থেকে বি-টেক এবং বুন্দেলখণ্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে এম-টেক করেন। এরপর অচিরাচরিত শক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেন সুদীপ্ত। ২০১৮ সালে তিনি জানতে পারেন ব্রাজিলে পলিথিনের বিকল্প হিসাবে উদ্ভিজ্জ স্টার্চ দিয়ে তৈরি অর্গানিক পলিমার জনপ্রিয় হয়েছে। ব্যবহারের পর ওই ধরনের পলিমার সম্পূর্ণ ভাবে নাকি মিশে যায় প্রকৃতিতে। এই অতিমারীর মধ্যে দেশে ফিরে বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করেন একটি সংস্থা “লালন”। আর সুদীপ্ত এই ক্যারিব্যাগ গুলোর নামও দিয়েছেন লালন।

এই মুহূর্তে কলকাতার বাজারে সুদীপ্ত নিয়ে এসেছেন ২ কিলো, ৫ কিলো, ১০ কিলো, ১৫ কিলো, ২০ কিলো, ২৫ কিলো মাল বহন করতে পারে এমন ক্যারিব্যাগ। যে মুহূর্তে প্লাস্টিক দূষণে কলুষিত পৃথিবী সেখানে দাঁড়িয়ে সুদীপ্তর এই লালন ক্যারি ব্যাগ বাড়তি অক্সিজেন দিলো সমাজকে। জানা গিয়েছে, এখন চেন্নাই থেকে তৈরি হয়ে আসছে এই ব্যাগগুলো। তাই দাম একটু বেশি পড়ছে। সুদীপ্ত জানিয়েছেন যদি সরকারি স্তরে প্লাস্টিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন কার্যকর হয় আর সরকার যদি এই ধরনের বায়ো ডিগ্রেডেবল ব্যাগ ব্যবহারের জন্য উৎসাহ দেয় তাহলে ভবিষ্যতে কলকাতাতেই লালনের উৎপাদনের জন্য একটি কারখানা তৈরি করবেন তাঁরা।
আলুর স্টার্চের পর এবার লালনের ভাবনায় আছে ক্যাকটাসের স্টার্চ দিয়ে ব্যাগ তৈরি করার। ইতিমধ্যে দক্ষিণ কলকাতার দুটি বাজার সমিতি পরীক্ষামূলকভাবে এই থলিগুলো ব্যবহার করতে আগ্রহ দেখিয়েছে।