কলকাতা ব্যুরো: স্যাড, মেলোডিয়াস কিংবা যেকোনো রাগ। সব ক্ষেত্রেই অবলীলায় ফুটিয়ে তুলেছেন সুরের মূর্ছনা। যেখানে স্পর্শ করেছেন তাই যেন সাধারন থেকে এক নিমেষেই অতিসাধারন হয়ে উঠেছে। সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বী অনেকেই ছিলেন, ছিলেন তাবড় অনেকেই। কিন্তু তিনি শুধু তিনিই। একবিংশ শতাব্দীতে এসে দাঁড়িয়েও তিনি যে আগের মতোই হার্টথ্রব। বর্তমান প্রজন্মও তাঁর সৃষ্টিশীলতায় যেমন খুঁজে ফেরে রোম্যান্টিসিজম, আবার বেদনা ভরা মুহূর্তেও তিনিই যে একমাত্র বেঁচে থাকার গুরুত্বপূর্ণ রসদ।
কোণও নির্দিষ্ট ঘরানায় তাঁকে বেঁধে রাখতে পারেন নি কোণও সঙ্গীত পরিচালকই। পাগলামি, হাসি-ঠাট্টা, মজা, ক্ষেপামি, মুডি, হিসেবি সব ছিল তাঁর অলঙ্কার স্বরূপ। আজ প্রযুক্তি উন্নত, অনেক প্রতিভাবান শিল্পী আসছেন, সঙ্গীত জগতে তাঁদের সেরাটা দিয়ে শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিচ্ছেন। কিন্তু ঘুরে ফিরে আসছে সেই সব সৃষ্টি। “রিমেক” হয়ে ফিরে আসছে যুব প্রজন্মের কাছে। সেখানেও ঘুরে ফিরে বারবার ফিরে আসছেন তিনি। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম বললে হয়তো ভুল হবে। তিনি যে সকলের, সর্বকালের। সত্যি নামে যে সবকিছু আসে যায় না, কিন্তু হ্যাঁ মানুষটির মতো নামেও যে তাঁর চমক। আসল নাম আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ওরফে কিশোর কুমার। আজ তাঁর ৯২ তম জন্মবার্ষিকী।
১৯২৯ সালে জন্ম ভারতীয় সিনেমার কিংবদন্তী শিল্পী কিশোর কুমারের। বাবা কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায় পেশায় ছিলেন আইনজীবী। চার ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন কিশোর কুমার। অশোক কুমার সবার বড় তারপর দিদি সতী দেবী তারপর অনুপ কুমার ও সর্বকনিষ্ঠ কিশোর কুমার। নাচ, গান, অভিনয়–সব দিকেই সমান পারদর্শী ছিলেন তিনি। তাঁর মতো বহুমুখী প্রতিভাধর শিল্পী ভারতীয় সিনেমায় বিরল। পরপর আটবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন তিনি। সে রেকর্ড এখনও ভাঙতে পারেননি কোনও শিল্পী। মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ায় জন্ম হয় তাঁর।
‘বম্বে টকিজে’ কোরাস সিঙ্গার হিসেবে কাজ শুরু। অভিনয়ের থেকেও গান যে ছিল তাঁর সবথেকে বেশি আপনার। যদিও ‘শিকারি’ ছবি দিয়ে শুরু করেন অভিনয়। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৫ এর মধ্যে ২২টি ছবিতে কাজ করেন কিশোর কুমার। তাঁর মধ্যে ১৬টি ফ্লপ ছবি। তারপর ‘লড়কি’ ও ‘বাপ রে বাপ ‘ছবিতে সাফল্য পাওয়ার পর অভিনেতা হিসেবে তাঁকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন পরিচালক-প্রযোজকরা। তবে, সাফল্য থাকলেও জীবনে বিতর্ক কম ছিল না তাঁর। ১৯৭০ সালে “রূপ তেরা মস্তানা” সানের জন্য প্রথম ফিল্মফেয়ার আ্যওর্য়াড পান কিশোর কুমার। প্রথমবার ভারতীয় গানে ইউডলিং-এর ব্যবহার তিনিই শুরু করেন। তবে তাঁর গানের মধ্যে ইওডেলিং স্টাইল বিখ্যাত সংগীত শিল্পী জিমি রজার্স এবং টেক্স মর্টন-এর স্টাইল থেকে অনুপ্রাণিত।
তিনি তাঁর জীবনে চারবার বিয়ে করেছিলেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী রুমা গুহ ঠাকুরতা। আট বছরের দাম্পত্য জীবন তাঁদের। এরপর কিশোর কুমার মধুবালাকে বিয়ে করেন, কিন্তু তা মেনে নিতে পারেননি। যোগিতা বালী ছিলেন কিশোর কুমারের তৃতীয়া স্ত্রী। মধুবালার মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পরে, যোগিতা বালীকে বিয়ে করেছিলেন কিশোর। পরে যোগিতা মিঠুনের সঙ্গে সম্পর্কের কারনে ছেড়ে চলে যান কিশোরকে। তারপর দক্ষিণের অভিনেত্রী লীনা চন্দভরকর-কে বিয়ে করেন কিশোর। তবে শোনা যায় যোগিতা বালি তাঁকে ছেড়ে মিঠুন চক্রবর্তীকে বিয়ে করায় গান বন্ধ করে দেন এই কিংবদন্তী শিল্পী। তাঁর দুটি সন্তান রয়েছে অমিত কুমার ও সুমিত কুমার। দু’জনেই সংগীত শিল্পী।
কিশোর কুমারের অন্যতম পছন্দের খাবার ছিল জিলিপি। তাই প্রতিবছর খান্ডোয়াতে জন্মদিনের এই বিশেষ দিনে তাঁর সমাধির সামনে জিলিপি রাখা হয়। এ বছরও তার অন্যথা হয়নি। সারা দেশের পাশাপাশি বাংলা তথা কলকাতাতেও আজকের দিনটি বড্ড সুরেলা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কিশোর কুমারকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিচ্ছেন অগণিত গুনমুগ্ধ ভক্ত থেকে সাধারন মানুষ। এদিন প্রতিবছরের মতো এবছরও বাংলার মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস টালিগঞ্জে গায়কের জন্মদিনে মূর্তিতে মালাদিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
শেষ জীবনে একেবারে একাকীত্বে দিন কাটিয়েছেন তিনি, বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নিজের একাকীত্বের কথা বলেছেন। কিশোর কুমার ছিলেন বাপ্পি লাহিড়ীর মামা। ১৯৮৭ সালে ১৩ অক্টোবর মুম্বইতে মারা যান এই কিংবদন্তী শিল্পী। kolkata361.in-এর তরফ থেকে কিংবদন্তীর ৯২ তম জন্মবার্ষিকীতে জানাই শুভেচ্ছা ও সশ্রদ্ধ প্রনাম।