কলকাতা ব্যুরো: আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ঘিরে ক্রমেই আইনি জাল শক্ত হচ্ছে বহরমপুর পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান নীলরতন আড্ড-র বিরুদ্ধে। আর ততোই পাল্লা দিয়ে তাকে ঘিরে জোড়ালো হচ্ছে রাজনৈতিক গুঞ্জন।
নবাবদের মাটি মুর্শিদাবাদে এ যেনো এক অন্য নবাবির গল্প। তবে এখানেও আছে বিশ্বাস – অবিশ্বাস, ক্ষমতার দখল, দ্বন্দ্ব, পিছন থেকে ছুরি মারার মতো হাজারো ওঠা নামা। সিরাজের রাজত্বের সেই ছবি ফ্ল্যাশ ব্যাকে যেনো মুর্শিদাবাদের মানুষকে পৌছে দিয়েছে বর্তমান বহরমপুর পুরসভার কাহিনী।
মুর্শিদাবাদের বহরমপুর পুরসভার একনাগাড়ে প্রায় দেড় দশকের বেশি সময় চেয়ারম্যান ছিলেন নীলরতন আড্ড। নিজের পদের অপব্যবহার করে একদিকে বেআইনি ভাবে শহরে নির্মাণ অনুমতি দেওয়া, অন্যদিকে নামে-বেনামে সম্পত্তি তৈরি করা নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল।
কিন্তু শেষ নয় সেখানেই। তাঁর বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান পদ বেআইনিভাবে ব্যবহার করে সম্পত্তি তৈরির অভিযোগে ভিজিলান্স কমিশনের কাছে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। আবার একই সঙ্গে তাঁর এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের নামে সম্পত্তি গড়ার অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে হাইকোর্টে। বহরমপুরের আইনজীবী অরূপ কুমার সিনহা এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়ে মামলা করেছেন হাইকোর্টে। সম্ভবত ২৪ সেপ্টেম্বর সেই মামলার শুনানি।
বাংলার শেষ নবাবকে সরিয়ে তাকে সিংহাসনে বসালে লর্ড ক্লাইভদের টাকা পয়সা, ধন রত্ন দেওয়ার টোপ দিয়েছিলেন মীর জাফর। আজকের মুর্শিদাবাদের অধীর চৌধুরীর এক সময়ের বিশ্বস্ত সেনাপতি তার সঙ্গ ছেড়ে গেলেন। বহরমপুর পুরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে ২০০২ সালে তিনি ছিলেন অধীর চৌধুরীর লোক। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি চলে যান তৃণমূলের সঙ্গে। যদিও চেয়ার তার থেকে গিয়েছিল।
সম্পত্তি সংক্রান্ত অভিযোগ কি কি?
কোনও লিজের শর্ত না মেনে পুরসভার তৈরি দোকান ঘর প্রভাব খাটিয়ে নিজের আত্মীয়দের দিয়ে দেওয়া।
পুর আইনের ধার না ধরে বেআইনি নির্মাণ অনুমোদন দিয়ে, সেখান থেকে নিজের আত্মীয়দের নামে ফ্ল্যাট বাগিয়ে নেওয়া। একইসঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য জায়গা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ।
বহুক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য মিউনিসিপাল আইনের দফারফা করে বহুতল আবাসন বেআইনিভাবে তৈরির অনুমোদন দেওয়া।
তিনি শহরে তিনটি ফ্লাটের মালিক বলে অভিযোগ মামলায়।
বেআইনি নির্মাণ মদত দিয়ে প্রাক্তন চেয়ারম্যান ১৩৮৬ বর্গফুট ১০৬৬ বর্গফুট ও ১৩০০ বর্গফুটের তিনটি ফ্ল্যাট বেআইনিভাবে দখল করেছেন বলেও মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, পুরো আইনকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে যেখানে ৪৭.৬ মিটার উচ্চতার আবাসন করা যায়, তিনি সেখানে ৬১ মিটার উচ্চতার আবাসন করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন।
অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের প্রাপ্য সাড়ে সাত কোটি কোথায়?
গত দেড় দশক ধরে প্রায় সাড়ে ৪৫০ পুরো কর্মী অবসর নেওয়ার পর কোনরকম আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। তাদের অবসরকালীন আর্থিক প্রাপ্য, হিসেব মতো প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকার কোন হিসেব নেই। ফলে অনেকেই এখন হাইকোর্টের কাছে মামলা করে সুরাহা চাইছেন।
মীরজাফরকে চেয়ারে বসিয়ে সিরাজউদ্দৌলার সম্পত্তি, টাকাপয়সা হাতানোর আশা পূর্ণ হয়নি। ফলে মীরজাফরকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার বেশ কিছুদিন পরেই আস্তে আস্তে বহরমপুর পুরবোর্ড চলে যায় রাজ্যের শাসকদলের ছাতার নিচে। কিন্তু ক্ষমতায় থেকে যান নীলরতনরা। আর ২০১৮ সালে বোর্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেই তাকে আর প্রশাসক বোর্ডের মাথায় বসানো হয়নি। সরকারি অফিসারকে প্রশাসক করে এখন চলছে পুরসভা। ব্রিটিশরা আশাহত হয়েছিল মীরজাফরকে চেয়ারে বসানোর পর। ফলে তাকে সরিয়ে দিয়ে তার জামাই মীর কাসেমকে বসানো হয়েছিল চেয়ারে। যেমন এখন চলছে।
যদিও মীরজাফর ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে একেবারে সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি। রাজনীতির দাবার চালে তিন বছরের মধ্যেই আবার ইংরেজদের ম্যানেজ করে ফেলেছিলেন। মীর কাসেমকে সরিয়ে ব্রিটিশ আবার সিংহাসন দিয়েছিল সেই মীরজাফরকেই।
রাজনীতির ভোজবাজি
নবাবের আমলের পাত্র-পাত্রীরা আজও আছেন। ঘষেটি বেগম, রায়দুর্লভ অথবা রাজবল্লভ, ইয়ার লতিফদের আজও দেখা যায়। সিরাজের প্রায় হারাতে বসা রাজত্বে এখন তাদের নাম শুধু বদল হয়েছে, এই যা।
এক সময় যারা মীরজাফরের সঙ্গ দিয়ে সিরাজউদ্দৌলাকে পথে বসিয়েছিলেন, পরে তারাই আবার ব্রিটিশের সঙ্গ দিয়ে মীরজাফরের চেয়ার কেড়ে নিতে মন্ত্রণা দিয়েছিলেন। ইতিহাস জেনো ফিরে ফিরে আসে।
একসময়ের প্রবল ক্ষমতাশালী নীলরতন আড্ড ক্ষমতা হারিয়ে এখন প্রায় এক পাশে। তার দলের একাংশ এখন পিছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা করছে বলে পাল্টা অভিযোগ প্রাক্তন চেয়ারম্যান এর ঘনিষ্ঠদের।
আমজনতার তরফেও কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, নীলরতন আড্ড এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে দল যদি জানতো, তাহলে কেন এতদিন তাকে ওই পদে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। নাকি তাকে সামনে রেখে সকলেই নিজের মতো করে সিদ কেটেছেন? যদিও সে প্রশ্নের জবাব এখন কেউই দিচ্ছেন না।
উল্টাবে পাশা?
মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পুরসভার প্রশাসক হিসেবে অন্যান্য পুরসভায় চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দিয়েছে রাজ্য সরকার। বহরমপুরে অবশ্য সরকারি অফিসারই এখন প্রশাসক। কিন্তু সেখানে আবার জনপ্রতিনিধিদের প্রশাসক বোর্ড কে দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত রয়েছে। ফলে সেই প্রশাসক হিসেবে আবার তিনি না চেয়ারে বসে পড়েন সেই চেষ্টা নাকি এখন চলছে পিছন থেকে। আর তাই নাকি এত দিন পরে একে একে তার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ বেরিয়ে আসছে। সূত্রের খবর, তিনি ও অবশ্য বসে নেই।
যদিও তার বিরুদ্ধে অভিযোগকে খুব একটা আমল দিচ্ছেন না প্রাক্তন পুর চেয়ারম্যান। তার বক্তব্য, ২০১৮ সালে যখন চেয়ার ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম, তখনই সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। তাহলে হঠাৎ কেন এখন এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে! আর ভিজিলান্স সম্পর্কে তার বক্তব্য, যদি ভিজিলান্স তদন্ত করার হতো তাহলে তখনই করতে পারত। তার মোদ্দা কথা, বেআইনি কিছুই করেননি।
তিনি কি প্রশাসকের চেয়ারে বসছেন? ছোট্ট প্রশ্নে তিনি সামান্য চুপ।
তিনিও অবশ্য রাজনীতির প্যাঁচ ভালোই জানেন। তাই কিছুটা যেন দাতে দাত চেপে শুধু বললেন, একবার যদি বসি আবার চেয়ারে…….
১৭৬০ সালে মীরজাফরকে সরিয়ে নবাবের চেয়ারে বসানো হয়েছিল মীর কাসেমকে। আবার তিন বছরের মাথায় সেই চেয়ার দখল করেছিলেন মীরজাফর। মুর্শিদাবাদের মাটিতে ইতিহাস কি আবার ঘুরে আসবে? কৌতুহলী বহরমপুরের মানুষ।