কলকাতা ব্যুরো: মাঝে কেটে গিয়েছে বারোটা বছর। মুম্বাই আবার কর্মচঞ্চল হয়েছে। ক্ষত সারিয়ে ফেলেছে দেহের। যেসব জায়গাগুলো ১২ বছর আগের ২৬/১১ এ গুলি আর গ্রেনেড ছুড়ে ক্ষত তৈরি করেছিল পাকিস্তানি জঙ্গিরা,’ সেই তাজ হোটেল, লিওপোল্ড হোটেল, হসপিটাল, ছত্রপতি শিবাজী রেল স্টেশন থেকে মুম্বাইয়ের কত সব গুরুত্তপূর্ণ জায়গাগুলো থেকে ক্ষত সারানো হলেও, সারাদেশ আজও মাথায় রেখেছেন সেই ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বরকে।

পাকিস্তানের হামলায় প্রায় তিন দিন ধরে স্তব্ধ হয়ে থাকা দক্ষিণ মুম্বাইয়ের এই সব জায়গায় একে একে প্রাণ গিয়েছিল ১৯০ জন মানুষের। সেখানে আমজনতার সঙ্গেই মারা গিয়েছিলেন একাধিক পুলিশ অফিসার। যাদের সাহসের কথা আজও স্মরণ করছে পুলিশ মহল থেকে সাধারণ মানুষ। শহর তার দেহের ক্ষত মুছে দিলেও ২৬/১১র সেই দিন গুলো কে কি ভুলতে পেরেছেন বাসিন্দারা? ভোলা তাদের সম্ভব হয়নি, যাঁদের ১২ বছর আগে সেই বিভীষিকাময় দুটো দিনের সাক্ষী হতে হয়েছিল। যেমন ছত্রপতি শিবাজী স্টেশনের বাইরে ফুটপাতে গুমটি দোকানে বসে থাকা দিবাকার ওমলে তার চোখের সামনেই দেখেছিলেন এক যুবককে। যার হাতে ঘুরছে এ কে ফরটিসেভেন রাইফেল পিঠে একটা ব্যাগ। দ্রুত স্টেশনের ভিতরে ঢুকেছিল।

তাজ হোটেলের সামনে একটি বিউটি পার্লার চালাতেন অনামিকা গুপ্ত। তিনি জঙ্গিদের ছোড়া চারটি গুলিতে গুরুতর ঘায়েল হন। সম্প্রতি এক টিভি সাক্ষাৎকারে অনামিকা বলেছেন, হামলা হওয়ার দু’দিন আগেও তিনি আজমল কাসাবকে তাজ হোটেলের আশপাশে ঘুরাঘুরি করতে দেখেছিলেন। সে কথা তিনি পুলিশকে জানিয়েও ছিলেন। কিন্তু এখন আর তা নিয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলতে চান না। যেদিন জঙ্গিরা হামলা চালালো তাজ হোটেলে, সেদিন সেখানেই নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলেন সেখানকার হেড শেফ হেমন্ত ওবেরয়। তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, জঙ্গিরা হোটেলে ৩০ জনকে খুন করেছিল। তিনি অবস্থা বুঝে হোটেল থেকে তার সহকর্মী ও বোর্ডারদের নিরাপদে বের করেছিলেন। বেশ কয়েকজনকে ঘুরপথে বের করে দিতে সক্ষম ও হন তিনি।

অঞ্জলি নামে এক তরুনীর মাকে পাটনায় ফেরার জন্য তার বাবা সেই দিন ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাল স্টেশনে ট্রেনে তুলতে গিয়েছিলেন তার বাবা। ঠিক তখনই স্টেশনে জঙ্গিদের গুলিতে মৃত্যু হয় তার বাবার। তিনিও এই দিনটির কথা স্মরণ করেন। একদিকে বাবার জন্য কষ্টে, অন্যদিকে সেইসব পুলিশ অফিসারদের কথা ভেবে, যারা কিছু নাগরিককে বাঁচাতে গিয়ে জঙ্গিদের গুলিতে মারা গিয়েছেন। আজ অঞ্জলি ভাবেন, সেইসব পুলিশ অফিসারদের ছেলেমেয়েরাও তাদের বাবা বা নিকট থেকে হারিয়েছেন জঙ্গিদের হামলায়।

যে পুলিশকর্মীরা সেদিন মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেদের জীবন দিয়েছিলেন জঙ্গিদের বুলেটের সামনে তাদের আজও স্মরণ করছে গোটা দেশ। মুম্বাই অ্যান্টি টেররিজম প্রধান হেমন্ত কারকারে রাত সাড়ে ন টা নাগাদ বাড়িতেই খবর পান ছত্রপতি স্টেশনে জঙ্গি হামলার। দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে আসেন। তার সঙ্গেই এসেছিলেন অশোক কামটে ও বিজয় সালাস্করের মত পুলিশ অফিসার। দুই জঙ্গি তখন ওই এলাকায় একটি গাড়ি থেকে চালককে টেনে রাস্তায় প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাতে চেপে বসেছিল। সেখান থেকে সামান্য দূরে কামা হসপিটালের সামনে তাদের সঙ্গে গুলির লড়াই শুরু হয়। পুলিশের জখম হয়। এক জঙ্গি জখম হয়। অন্য জন মারা যায়। সেই জখম জঙ্গী আজমল কাসাব। জঙ্গি কাসবের গুলিতে ওই তিন পুলিশ অফিসার মারা যান সেখানেই।

সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে মুম্বাই পুলিশ কাজে যুক্ত হয়েছিলেন তুকারাম অম্বলে। সেদিন আজমল কাসবকে জাপটে ধরতে গিয়ে, তার হাতের রাইফেল টাকে জোড়ে চেপে ধরেছিলেন তুকাড়াম। কিন্তু শক্তি প্রদর্শনে সেদিন তুকারামকে হারিয়ে আজমল কাসাবের রাইফেল প্রায় এক ডজন গুলি একেবারে বুকে বিধিয়ে দিয়েছিল তুকারামকে। মেজর সন্দ্বীপ উন্নিকৃষ্ণন কে ও ভুলতে পারবেনা মুম্বাই। এন এস জি কমান্ডারদের নেতৃত্বে থাকা সন্দ্বীপ সেদিন প্রায় ৫০ জনকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত এক জঙ্গির মুখোমুখি হন, যার এক হাতে গ্রেনেড আর অন্য হাতে তখনও ধরা একে ৪৭ রাইফেল। ব্ল্যাক ক্যাট বাহিনী জঙ্গিদের কোণঠাসা করতে করতে তাজ হোটেলের রেস্তোরাঁয় আটকে দিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই একেবারে একা সন্দ্বীপ উন্নিকৃষ্ণন পড়ে যান একজন জঙ্গির আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে। ফলে জীবন দিয়ে তাকে মুখোমুখি হতে হয় জঙ্গির। এই এক হামলাকে সামনে রেখেই জঙ্গিরাও চোরাগোপ্তা নতুন হামলার ছক কষছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আর ভারতীয় এজেন্সিগুলো তাদের প্রতিরোধে নিরন্তর লড়ে যাচ্ছে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version