ফুরিয়ে আসা ২০২৪-এর বছরটি ছিল পৃথিবী জুড়ে নির্বাচনের বছর। জাতিসংঘ চলতি বছরটিকে ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বছর’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। এই বছর বিশ্বের প্রায় ৩৭০ কোটি মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। ভারত থেকে পাকিস্তান, রাশিয়া থেকে আমেরিকা-সহ অন্তত ৭৩টি দেশে এই বছর ভোট হয়েছে। এই বছর আমেরিকায় ভোটে ডোনাল্ড টাম্প নতুন করে যেমন হোয়াইট হাউজে ফিরেছেন অন্যদিকে ভারতে নরেন্দ মোদি ও রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিন তাঁদের জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন।৮০০ কোটি জনসংখ্যার এই পৃথিবীতে ২০২৪ সালে নিজেদের মত প্রকাশ করেছেন প্রায় অর্ধেক মানুষ। অর্থাৎ ভোটের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দের নেতা, রাষ্ট্র প্রধান বা সরকার প্রধান নির্বাচিত করেছেন তারা। বিশ্বজুড়ে নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই বছর।

বছরের শুরুতেই গত ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের নির্বাচন হয় পাকিস্তানে। কারাবন্দি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ভোটের লড়াই থেকে দূরে রেখেই ভোট হয় দেশটিতে। নির্বাচনে কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট গড়ে ক্ষমতায় পৌঁছায় নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ। প্রধানমন্ত্রী হন পিএমএল-এনের নেতা শাহবাজ শরিফ।

মার্চের মাঝামাঝিতে ভোট হয় রাশিয়ায়। ভো্টে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ভ্লাদিমির পুতিন। নির্বাচনে ৮৭. ৮ শতাংশ ভোট পড়ে তার পক্ষে। এবারের নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ২০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকছেন পুতিন। ১৯৯৯ সালে প্রথম ক্ষমতায় বসেছিলেন তিনি। এরপর থেকে তিনি ধারাবাহিকভাবে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন।

১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের ভোটের লড়াই। সাত দফায় হয় ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। কোনো রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় জোট সরকার গঠন করে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ। টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নরেন্দ্র মোদী। এবারের নির্বাচনে রাহুল গান্ধীর চমকে গতবারের চেয়ে বেশি আসন পায় কংগ্রেস। লোকসভার বিরোধী দলীয় নেতা হন রাহুল গান্ধী

চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটেনে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে বেশ দ্রুততার সঙ্গে। ব্রিটেনের ভোটে জয়ী হয় লেবার পার্টি। কনজারভেটিভ পার্টি পায় ১২১টি আসন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ব্রিটেনে টানা ১৪ বছর পর ক্ষমতা থেকে সরে যায় কনজারভেটিভ পার্টি। রাজা চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান ঋষি সুনাক। পরে রাজার সঙ্গে দেখা করেন নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। তাকে সরকার গঠন করার আমন্ত্রণ জানানো হয়। বাকিংহাম প্যালেস থেকে ফিরেই মন্ত্রিসভা গঠনের কাজ শুরু করেন লেবার পার্টির এই নেতা।

ইরানে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আগামী বছরের জুনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত ১৯ মে ইব্রাহিম রাইসি এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মারা গেলে প্রেসিডেন্ট পদটি শূন্য হয়ে যায়। সংবিধান অনুযায়ী ৫০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা থাকায় প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে দেশটি। ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাচিত হন সংস্কারপন্থি নেতা মাসুদ পেজেশকিয়ান। নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা ভোটে কট্টরপন্থি সাঈদ জালিলিকে পরাজিত করেন সংস্কারপন্থি এই নেতা।

শ্রীলঙ্কায় গণ-বিক্ষোভের মুখে রাজাপাকসে সরকারের পতনের পর অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে জিতে ৫৫ বছর বয়সি অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তিনি ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার নামে রাজনৈতিক জোটের নেতৃত্ব দেন। দলটিকে চীনের ঘনিষ্ঠ বলেই মনে করা হয়। ভারত ও চীন দুই দেশই দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। গত কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা করেছে দুই দেশ। শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার ভারত ও চীনের সঙ্গে কীভাবে ভারসাম্য বজায় রাখবে, তা নিয়ে এরইমধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

সারা দুনিয়ার এই সব দেশের মধ্যে সবচেয়ে চমক জাগানো নির্বাচন ছিল আমেরিকায়। প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পাচ্ছে আমেরিকা এমন সব আলোচনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকার ইতিহাসে ট্রাম্প একটি অনন্য রেকর্ড করেন। ১৩০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে ট্রাম্প হলেন হোয়াইট হাউজে ফিরে আসা প্রথম প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার রায়, নির্বাচনের আগে তাকে হত্যা চেষ্টা-সহ নানা কারণে এই নির্বাচনের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও ইউরোপ-এশিয়া-আফ্রিকা-আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের নির্বাচন আলোচনায় ছিল এই বছর।