দেবী সরস্বতী। তিনি বিদ্যার দেবী। বাঙালি দেবী সরস্বতীকে বসন্ত পঞ্চমীতে আরাধনা করে। আবার, দুর্গাপুজোর সময়ও তাঁকে দেবী দুর্গার সঙ্গে দেখা যায়। সেই সময়ও দেবী সরস্বতীর মর্ত্যে আগমন ঘটে।

বীরভূমের হাজারো অজানা ঐতিহ্যের ভিড়ে এক নতুন সংযোজন সিউড়ী লম্বোদর পুরের সাধু বাড়ির সরস্বতী পুজো। হেতম পুর রাজবাড়ীর গমোস্তা ছিলেন এই বংশের কোনো এক পূর্ব পুরুষ।তাঁরই চেষ্টায় আজ থেকে শতাধিক বছর আগে এই পুজোর সূত্রপাত। এই পুজোর বৈশিষ্ট্য হলো এখানে দেবী সরস্বতীর সঙ্গেই দেবী লক্ষ্মী, জয়া, বিজয়া ও ভগবতী ও পূজিত হন। দু’ দিন ধরে চলে এই পুজো। সাধু বাড়ির বর্তমান প্রজন্ম এখনো নিষ্ঠার সঙ্গে এই পুজোকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। একই ধরনের পুজোর সন্ধান পাওয়া বীরভূমের আরও কিছু অঞ্চলে, যেমন রাজনগর, কড়িধ্যা, খয়রাকুড়ি, লাউবেড়িয়া ইত্যাদি।

সপরিবারে দেবী সরস্বতী ৩০০ বছর ধরে পূজিতা হচ্ছেন। দেবী সরস্বতীর দুই বোন আছে। সেই বোনেদের সঙ্গে একই মন্দিরে পুজো হয় দেবী সরস্বতীর। এমন খবর বেশিরভাগ বাঙালি ভক্তেরই জানা নেই। অথচ, এই বাংলাতেই প্রায় তিনশো বছর ধরে স্থায়ী মন্দিরে পূজিতা হচ্ছেন দেবী সরস্বতী। আর, সেখানে দেবীর সঙ্গে পূজিতা হন তাঁর দুই বোনও। জায়গাটা হল বীরভূমের তাঁতিপাড়া। যেখানে দেবী সরস্বতী তাঁর দুই বোনের সঙ্গে পূজিতা হচ্ছেন ৩০০ বছর ধরে। এখানে মণ্ডপ স্থায়ী। প্রতিমা প্রতিবছর নতুন করে আনা হয়। ফলে, বছরের অন্য সময় এলে এই প্রতিমা হয়ত দেখা যাবে না। এই প্রতিমা দেখতে হলে সরস্বতী পুজোর সময়ই আসতে হবে তাঁতিপাড়ার মণ্ডপে। জায়গাটা বীরভূমের রাজনগর ব্লকের অন্তর্গত। গ্রামে এসে বাসিন্দাদের কাছে বলতে হবে, সরস্বতীতলায় যাব। যে কেউ দেখিয়ে দেবে এই মন্দির।

এরচেয়েও প্রাচীন এক মন্দির রয়েছে কাছেই। সেখানে ৩০০ বছর ধরে সপরিবার দেবী সরস্বতী পূজিতা হচ্ছেন। এখানে দেবী সরস্বতীর স্থায়ী মন্দির রয়েছে। বীরভূমের কড়িধ্যার বিখ্যাত উদীচি কালীমন্দিরের পাশ দিয়ে এই সরস্বতী মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা। জায়গাটার নাম পাঠশালা পাড়া। আগে এই সরস্বতী মন্দির ছিল পাঠশালার ছাত্রাবাস। সেটাই বর্তমানে পাঠশালাপাড়ার সরস্বতী মন্দির নামে খ্যাত। এখানে সরস্বতীর সঙ্গে দুর্গা এবং লক্ষ্মী রয়েছেন।

পাশাপাশি একচালা প্রতিমার সঙ্গে রয়েছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর- ত্রিদেবের মূর্তি। দেবীর সঙ্গে এই নাটমন্দিরে তাঁরাও পূজিতা হন। দুই জায়গাতেই দুর্গা ও লক্ষ্মীকে দেবী সরস্বতীর বোন হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর, সেভাবেই তাঁদের পুজোও করা হয়। দুই জায়গাতেই স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ বাড়িতে সরস্বতী পুজো করেন না। এই সব বাড়ির পড়ুয়ারা বসন্ত পঞ্চমীতে সপরিবারে বিরাজমান দেবীর স্থানে গিয়েই দেয় অঞ্জলি।

দুবরাজপুরের খোসনগর গ্রামে সরস্বতী পুজোর সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে পীর সাহেবের মাজারও! ধর্মকে কেন্দ্র করে দেশের নানা অংশে অসহিষ্ণুতা, তার মাঝেই শাল নদী ঘেঁষা দুবরাজপুরের গ্রামে দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির ছবি। গ্রামে ঢুকতেই ডান দিকে রয়েছে পীর কেরওয়ানী শাহ আবদুল্লা সাহেবের মাজার। প্রতি শ্রাবণের শেষ বৃহস্পতিবার পীর সাহেবের প্রয়াণ দিবস বা উরস উৎসব হয়। প্রচুর মানুষ আসেন। বছরের আরও একটি সময় ওই মাজারে ভিড় জমে। তা হল সরস্বতী পুজোর সময়। পীরসাহেবের মাজার দেখাশোনার দায়িত্ব থাকা দুই খাদিম (ভক্ত বা সেবায়েত) শাহজাহান মোল্লা এবং আব্দুল মীরন জানান, গ্রামের জমিদার পরিবারের শতাব্দী প্রাচীন সরস্বতী মূর্তির বিসর্জনের আগে পীরবাবার মাজারে সিন্নি (পায়েস বা ক্ষীর) চড়ানো রীতি। সিন্নি না-চড়ালে প্রতিমা বের করা যায় না বলে জানান সরস্বতী পুজোর শরিকেরা। গ্রামের সব চেয়ে প্রাচীন ওই মন্দিরের সরস্বতী পুজো ও সম্প্রীতির মেববন্ধন নিয়ে গর্বিত গ্রামের প্রত্যেকেই। বড়দের পাশাপাশি রংবেরঙের পোশাক পরে মন্দিরে ভিড় জমায় কচিকাঁচারাও।

খোসনগর গ্রামের শতাব্দী প্রাচীন সরস্বতী প্রতিমাও আর পাঁচটা গ্রামের থেকে আলাদা। দেবীর বাহন এখানে হাঁস নয়। বরং এক জোড়া বাঘ। এখানেই শেষ নয়। সরস্বতীর এক পাশে রয়েছেন মহালক্ষ্মী, অন্য পাশে রাজলক্ষ্মী। সঙ্গে রয়েছেন জয়া, বিজয়া। এবং আরও কয়েকটি পরী। দুর্গাপুজোর মতো এক চালায় এতগুলি প্রতিমা নিয়ে এক ভিন্ন আঙ্গিকের প্রতিমা।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version